দেশজুড়ে

তিন ভাইয়ের সাপ্লাইয়ে বগুড়ায় ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে বিপজ্জনক পটকা

বগুড়া পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের মালতিনগর এলাকায় গড়ে উঠেছে কোটি টাকার অবৈধ পটকার বাজার। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে আসা বিস্ফোরক (বারুদ) দিয়ে এইসব পটকা তৈরি করা হয় পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায়। শহরের মালতিনগরের এমএস ক্লাব মাঠ, মোল্লাপাড়া ও ভাটকান্দি এলাকায় অন্তত অর্ধশত বাড়িতে অবৈধভাবে পটকা তৈরি কারখানা গড়ে উঠেছে। অনেকটা কুটির শিল্পের মতো ঘরে ঘরে নারীরা এ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। পটকা তৈরির পর শহরের চুরপট্টি মার্কেটের দোকানিদের কাছে এগুলো পাইকারিতে বিক্রি করা হয়। এই মার্কেটে দুই ঈদ ও দুর্গা পূজাসহ বছরজুড়ে পটকার ব্যবসা থাকে জমজমাট।

রোববার (২৯ এপ্রিল) রাত ৯টার দিকে শহরের মালতিনগর এলাকার মোল্লাপাড়ায় খড়ি ব্যবসায়ী রেজাউল করিম ও রাশেদুল ইসলামের বাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর বিষয়গুলো সামনে আসে। তারা নিজ বাড়িতে অবৈধভাবে গড়ে তুলেছিলেন পটকার কারখানা। বিস্ফোরণে বাড়িতে থাকা তিন কিশোরীসহ চার নারী আহত হয়ে এখন চিকিৎসধীন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শহরের মালতিনগর এলাকার এমএস ক্লাব মাঠ এলাকার ওয়াজেদ আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম, নাসির হোসেন ও মো. বসির এই তিন ভাই পটকা কারখানাগুলো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তাদের স্বল্প পরিসরে বিস্ফোরক (বারুদ) আমদানি সাপেক্ষে পটকা তৈরির লাইসেন্স দেওয়া থাকলেও নিয়ম নীতির থোড়ায় কেয়ার করেন তারা।

অভিযোগ আছে, পুলিশকে মাসিক মাসোহারা দিয়ে আবাসিক এলাকায় ঘরে ঘরে অল্প পারিশ্রমিকে তিন ভাই পকটার কারখানাগুলো গড়ে তুলেছেন। ১৯৮৯ সালে পটকা তৈরির সময় বারুদের বিস্ফোরণে তাদের বাবা ওয়াজেদ আলী, মা নেবুর জান ও ৩ বছর বয়সী এক বোন নিহত হন। সর্বশেষ ২০২০ সালে মালতিনগরের এমএস ক্লাব মাঠ এলাকায় রফিকুলদের দেওয়া কন্ট্রাক্টে পটকা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে নিজ বাড়িতে শচীন নামে এক যুবক নিহত হন। এরপরও টনক নড়েনি জেলা প্রশাসন অথবা পুলিশের।

ভারত থেকে চোরাইপথে যেভাবে আসে বারুদ

উত্তরের তিন সীমান্ত জয়পুরহাটের হিলি, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও লালমনিরহাটের বুড়িমারী দিয়ে প্রতিদিনই বারুদ আসে দেশে। একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গোয়েন্দা শাখা সূত্র বলছে, এই তিন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত নারী-পুরুষ এসব বারুদ বগুড়াসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলায় সাপ্লাই দিয়ে থাকে। তারা বাজারের ব্যাগে করে নানা কৌশলে বিস্ফোরক বহন করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে অল্প অল্প করে সাপ্লাইয়ের এই পথ বেছে নিয়েছে চোরকারবারীরা।

বসতবাড়িতে যেভাবে তৈরি হয় পটকা

পটকার মূল উৎপাদক তিন ভাই রফিকুল ইসলাম, নাসির হোসেন ও মো. বসির এলাকাভিত্তিক তাদের কিছু প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। তাদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পটকা তৈরির সরঞ্জাম বারুদ, সুতা, আঠা, ফুয়েল প্যাকেট ও শক্ত বিশেষ কাগজ পৌঁছে দেওয়া হয়। বাড়িতে বসে নারীরা প্রতি হাজার পটকা তৈরির জন্য মাত্র ১০০ টাকা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন।

প্রথমে কাগজে বারুদ ভরে সুতা দিয়ে মুড়িয়ে দেন। এরপর আঠা দিয়ে ফুয়েল প্যাকেটে মুড়িয়ে তৈরি হয় পটকা। মূলত সূতা দিয়ে বাঁধার পর আঠা লাগিয়ে দেওয়ায় বারুদের উপরে চাপ তৈরি হয়, আর এই থেকে ঘটে বিস্ফোরণ। শহরের মালতিনগরের এমএস ক্লাব মাঠ, মোল্লানগ ও ভাটকান্দি এলাকার নিম্নবিত্ত ঘরের নারীরা এই পটকা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের কোনো প্রশিক্ষণ বা নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেনি কর্তৃপক্ষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রেজাউলসহ তার মা রেজিয়া, স্ত্রী রেবেকা ইসলাম এই পটকা তৈরির সঙ্গে জড়িত। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে রফিকুলের হয়ে পটকা তৈরির কথা জানিয়েছেন। এছাড়াও তার স্ত্রীও অন্য আরেকটি কাজ কন্ট্রাক্টে নিয়েছিলেন। সেটি রফিকুলের কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ডিএমপির বোম ডিসপোজাল ইউনিটের ঘটনাস্থল পরিদর্শন

সোমবার রাত ৯টার দিকে মালতিনগরে বিস্ফোরিত বাড়ি পরিদর্শন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বোম ডিসপোজাল ইউনিট। সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. মাহমুদুজ্জমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও নানারকম আলামত সংগ্রহ করে। এ সময় বিস্ফোরিত বাড়ি থেকে বস্তাভর্তি পটকা ও বারুদ উদ্ধার করে পাশে করতোয়া নদীর তীরে ধ্বংস করা হয়।

সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. মাহমুদুজ্জমান বলেন, আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে বিস্ফোরণের কারণ তদন্ত করে প্রতিবেদন জেলা পুলিশের কাছে পাঠানো হবে।

শহরের মালতিনগরের এমএস ক্লাব মাঠের সঙ্গে তিন ভাই রফিকুল, নাসির ও বসিরের বাড়ি। সরেজিমনে গিয়ে বাড়ি তালাবদ্ধ থাকায় তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।

তবে তাদের প্রয়াত বড় ভাইয়ের স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, ‘লাইসেন্স থাকায় ঈদে ও পূজায় পটকা তৈরি করা হয়। গতকালের বিস্ফোরণের পর থেকে রফিকুলরা বাড়িতে নেই। সেখানে কীভাবে কী হয়েছে এত কিছুতো আমরা জানি না। মামলা-টামলা হলেও পরে টাকা-পয়সা দিয়ে সব ম্যানেজ করা যাবে। ইচ্ছা করেতো কিছু ঘটানো হয়নি।’

একই এলাকার বাসিন্দা মুদী ব্যবসায়ী দুলাল মুন্সী বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে তিন ভাইকে এলাকায় দেখিনি। শুধু জানি তারা বাড়ি বাড়ি মালামাল দিয়ে পটকা তৈরি করিয়ে নেয়। তবে কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় তা তো জানি না। পুলিশও কখনো তাদের বাধা দিয়েছে এমনটি জানা নেই।

দুর্ঘটনাস্থলের স্থানীয় বাসিন্দা সাকিব আল হাসান বলেন, মোল্লানগরের অন্তত ২০টি বাড়িতে পটকা তৈরি হয়। সেদিনের ঘটনার পর থেকে সবগুলো বাড়ি থেকে পটকা তৈরির সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এলাকার সবার জন্য বিপজ্জনক।

বাড়িতে গিয়ে রফিকুলের দেখা পাওয়া না গেলেও কথা হয় মুঠোফোনে। তিনি নজরুলের কাছে পটকা বানাতে দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, ঈদের সময় তাদের কিছু মালামাল বানানোর জন্য দেওয়া হয়েছিল। হয়তো সেই সময়ের বেঁচে যাওয়া কিছু মালামাল তার বাড়িতে ছিল। তবে বারুদ বিস্ফোরণে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। নিম্নবিত্ত নারীরা যাতে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে পারে এজন্য তাদের কাজগুলো দেওয়া হয়। কারো ক্ষতিতো কেউ চায় না।

বারুদ কীভাবে ক্রয় করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে চায়না থেকে বারুদ আমদানি করা হতো। এখন ভারত থেকে আসা পটকা ভেঙে সেগুলোর বারুদ দিয়ে দেশীয় পটকা বনানো হয়।

বগুড়া পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিপার আল বখতিয়ার বলেন, আবাসিক এলাকায় প্রকাশ্যে পটকার এমন কারবার হলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমি কয়েকবার এগুলো বন্ধের চেষ্টা করেছিলাম। তবে বার বার ধরন পাল্টানোয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম বলেন, পুলিশের মাসোহারা বা আগে থেকে পটকার কারখানাগুলোর বিষয়ে জানার অভিযোগ সঠিক নয়। আমাদের স্থানীয় কেউ কখনো এসব বিষয়ে অবগত করেনি। তবে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পটকা উৎপাদনের অনুমোদন যদি কাউকে দেওয়া থাকে তাহলেও আবাসিক এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নেই। নজরদারির কোনো কমতি ছিল কিনা খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি এইসব অবৈধ পটকার করাখানা বা উৎপাদন বন্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

এফএ/এএসএম