বিশ্বে প্রতিবছরই নির্দিষ্ট একটি দিনকে ‘মা’ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। মায়ের জন্য মাত্র একটি দিবস, চিন্তাও করা যায়! জানি না, করপোরেট বিশ্বে কেন শুধু একটি দিবসকে নির্ধারণ করেছে মা’কে সম্মান জানানোর জন্য? বছরের বাকি দিনগুলোতে তাহলে কী হবে? মা’কে দূরে ঠেলে রাখবে? সেটাও জানি না, তবুও কেন যেন একটা উপলক্ষ ভেবে নিয়ে আমিও লিখতে বসে গেলাম। তবে, ভাবনায় এটাও কাজ করছে যে, মা’কে নিয়ে লিখতে তো কোনো দিবসের প্রয়োজন নেই!করপোরেট দুনিয়া হয়তো মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘বিশ্ব মা দিবস’ হিসেবে পালন করার রীতি বের করে নিয়েছে। যাদের কাছে মায়ের মূল্য মাত্র একদিনের জন্য, তারা তো বছরে একটি দিনকেই বেছে নেবে (এর পেছনে অধিকাংশই যে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না); কিন্তু আমার কাছে কোনো দিবস-টিবস নেই। বছরের ৩৬৫ দিনই তো আমার মায়ের জন্য। ‘মায়ের জন্য ভালোবাসা’ আমার সপ্তাহের সাতদিন প্রতিদিনই এবং দিনের ২৪ ঘন্টাই। যারা পুরো বছর মায়ের কোনো খোঁজ খবর রাখে না, ‘বিশ্ব মা দিবস’ শুধু তাদের জন্য। ওই একটি দিন মায়ের জন্য তারা আহ্লাদে মেতে ওঠেন। করপোরেট দুনিয়া কত সুন্দরভাবেই না মা থেকে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে।আমার মমতাময়ী ‘মা’। আপনাকে সম্মান-শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কিন্তু এ লেখা নয়। কলমের কালি দিয়ে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাকে কী পরিমাপ করা সম্ভব? কোনো ভাবেই না। আমার পৃথিবীজুড়ে শুধুই একজন। সে তো আপনিই। দু’কলম লিখে আপনার প্রতি আমার ‘ভালোবাসা’কে খাটো করতে পারি না। আপনার পদতলে যে আমার বেহেস্ত! তাহলে ছোট্ট এই পরিসরে আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসার কথা লিখে কিভাবে আপনাকে অসম্মান করি! সে সাহস আমার কোথায় বলুন!‘মা’ আজ আপনি আমার চেয়ে কত দূরে…! পথের পরিমাপে সেটা হতে পারে আড়াইশ’ কিংবা তিনশ’ কিলোমিটার; কিন্তু মায়ের সঙ্গে সন্তানের হৃদয়ের দূরত্ব কি কখনও এতটুকুন কমে? সেখানে তো এক সুতা পরিমাণও ব্যবধান নেই। অনেকে হয়তো তার মা থেকে হাজার কিলোমিটারও দূরে অবস্থান করেন; কিন্তু কেউ কি কখনও বলতে পারবেন, মায়ের সঙ্গে আমার দূরত্ব এত এত? সন্তানের সঙ্গে যে মায়ের নাড়ির সম্পর্ক! কোন বাপের ছেলের সাধ্যি আছে যে মাকে অস্বীকার করতে পারে?‘মা’ সন্তানদের কাছে আপনি কত আপন, কত কাছের তা কি কখনও ভেবে দেখেছেন? এই যা, এখানেই তো একটা ভুল করে ফেললাম। এটা তো মায়েরাই সবচেয়ে বেশি জানেন। ভেবে দেখার কি আছে? সন্তান মাকে যত কষ্টই দিক না কেন, মা যখন সন্তানের মুখের দিকে তাকান তখন সব কষ্ট ভুলে যান। আপন স্নেহে, আপন মমতায় তারা সন্তানকে কাছে টেনে নেন। পরম স্নেহে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন সন্তানের সকল দুঃখ-বেদনা। ‘মা’ বলেই এটা সম্ভব। মায়েরাই কেবল পারেন এতটা উদার হতে, এতটা স্নেহময়ী, মমতাময়ী হতে।মা’ আপনি জানেন কি না জানি না। মানুষের ব্যথা পরিমাপ করার জন্য বিজ্ঞান যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানই বলে, মানুষ সর্বোচ্চ ৪৫ ডেল (ব্যথা পরিমাপের একক) ব্যথা সহ্য করতে পারে। কিন্তু একজন মা যখন সন্তান জন্ম দেন তখন তিনি ৫৭ ডেল ব্যথা সহ্য করেন। যা একই সময়ে ২০টি হাঁড় ভেঙ্গে দেওয়ার সমান। সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে কতটুকু কষ্ট আপনাকে করতে হয় তা আমরা সন্তানরা বুঝব কি করে! বিজ্ঞান হয়তো এটা উপলব্ধি করতে সহায়তা করেছে। কিন্তু আপনাকে তো শুধু এ কষ্ট স্বীকার করেই বসে থাকতে হয় না। একটি সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে আপনার যে ত্যাগ, যে তিতিক্ষা তার ঋণ আমরা শোধ করবো কি করে? আমাদের কলিজাটা কেটে টুকরো টুকরো করে আপনার পদতলে রেখে দিলেও তো কখনও তা শোধ হবার নয়। সেই কষ্ট তো ৫৭ ডেলের চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি।‘মা’, প্রাণি জগতের অন্য যে সব প্রাণি আছে, তাদের সন্তানরা পৃথিবীতে আসার পর হাঁটতে জানে, দৌঁড়াতে জানে, উড়তে জানে কিংবা সাঁতার কাটতে জানে; কিন্তু একমাত্র মানুষ! শুধু মানুষই ব্যতিক্রম। তারা না পারে হাঁটতে-দৌড়াতে, না পারে উড়তে আর না পারে সাঁতার কাটতে। ক্ষুধায় ছটপট করলেও মানব সন্তান কখনওই পারে না নিজের খাবারটা চেয়ে খেতে; কিন্তু ‘মা’ আপনার হৃদয় কিভাবে যেন তা জেনে যায়। ছুটে এসে আপনি সন্তানের ক্ষুধা নিবারণ করেন। প্রচণ্ড শীতের রাতে যখন আপনার সন্তান বিছানায় প্রশ্রাব করে দেয়, তখন আপনি রেগে যান না, ছুঁড়েও ফেলে দেন না। পরম মমতায় সন্তানের ভেজা কাপড়, ভেজা বিছানা পাল্টে দিয়ে তাকে স্নেহের কোলে তুলে নেন। আড়াই বছর বুকের দুধ পান করান, লালন-পালন করে বড় করে তোলেন। ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ জানতে শেখান। আপনি কখনও আমাকে মিথ্যা বলতে শেখাননি, চুরি করতে শেখাননি। বলেননি অমুকের গাছের ওই আমটি পেড়ে এনে আমাকে খাওয়াও, অমুকের ওই জিনিসটি নষ্ট করে দিয়ে এসো। আপনি আমাকে শেখাননি কিভাবে দুর্নীতি করতে হয়, অপরের ক্ষতি করতে হয়। কোন মা’ই চায় না তার সন্তান খারাপ হোক। খারাপ পথে চলুক, খারাপ কামাই করুক।মা আমি আপনার সেই সন্তান। দেখুন আপনার ছেলে কত বড় হয়েছে। কিন্তু ‘মা’ আমি আপনার কাছে যে চিরকালই ‘ছোট্ট খোকা’! সেই ছোট্টটিই থেকে যাবো। জীবনে যত বড় হই না কেন, কোনদিন যদি কোন ভুল করি, তাহলে যেন সেই ছোটবেলার মত আমার ভুল ধরিয়ে দেন। শাসন করে যেন আপন স্নেহে আবার কোলে টেনে নেন। মা কোন বিশেষ দিবসে নয়, আমি আপনার কাছে এই মমতা চাই বছরের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ।আমার মা’ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ‘মা’। সব সন্তানের কাছেই এটা অমোঘ একটি সত্য কথা। প্রিয় পাঠক, আপনার মা যেন আপনার কাছে সত্যিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, সবচেয়ে আপন হতে পারেন সেটাই কামনা করি। আল্লাহই তো বলেছেন, আল্লাহ এবং মুহাম্মদ (সঃ) এর পর যেন মানুষের কাছে সবচেয়ে গ্রহণীয়, সবচেয়ে শ্রদ্ধার ব্যক্তি হন তার মা-বাবা। রাসুল (সঃ) নিজেই বলেছেন, ‘সম্মান করবে তোমার মাকে, এরপর তোমার মাকে, এরপর তোমার মাকে, এরপর তোমার বাবাকে।’ অর্থাৎ বাবার চাইতেও মায়ের মর্যাদা তিনগুণবেশি।এমন ‘মা’কেও যারা কষ্ট দেন তারা সত্যিই মানুষ কি না আমার প্রশ্ন জাগে। স্ত্রীর প্ররোচনায় হোক কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, মাকে অনেকেই কষ্ট দিয়ে থাকেন। হাল আমলে ঝামেলা মনে করে অনেকে বাবা-মাকে রেখে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে; কিন্তু যারা এ কাজ করেন কখনও কী ভেবে দেখেছেন তারাও একদিন বৃদ্ধ হবেন, তারাও মা-বাবা হবেন? তাদের নিয়তিতেও যে এমন কিছু লেখা নেই, তার নিশ্চয়তা কি? মা তো মা’ই। সন্তানের এমন আচরণও তারা কিভাবে যেন পরম মমতায় ক্ষমা করে দিতে পারেন! ভাবতে পারি না আল্লাহ তাদের হৃদয়ে কী এমন স্নেহের সমুদ্র সৃষ্টি করে দিয়েছেন!যাদের ‘মা’ আজ বেঁচে নেই, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য সম্পদটিই হারিয়েছেন। জন্মান্তরের বাঁধন ছিড়ে ‘মা’ আজ স্রষ্টার সান্নিধ্যে। পৃথিবীর সবাই আপনার কাছে ভালবাসার প্রতিদান চাইতে পারে, এমনকি আপনার স্ত্রীও; কিন্তু একমাত্র মা! মা’রাই পারেন কোন প্রতিদানের আশা না করে আপনাকে ভালোবাসতে। মায়ের অভাব আপনিই হয়তো বুঝতে পারবেন অনেক বেশি (ব্যস্ত এ পৃথিবীতে অনেকের অবশ্য সে বোধ এখন আর নেই)।মা আমরা আপনার সন্তান। অনেক ভুল, অনেক অপরাধ জেনে হোক বা না জেনে হোক, হয়তো করে ফেলেছি। মা আমরা জানি আপনি দয়ার সাগর। সন্তান যখন আপনার সামনে অপরাধ স্বীকার করে দাঁড়ায় তখন কোন ‘মা’র হৃদয় নরম হয় না বলুন! আপন মহিমায় আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন এটাই প্রত্যাশা। ‘মা’ দিবস বলেই নয় শুধু, বছরের প্রতিটি দিনই এ প্রার্থনা আপনার কাছে আমাদের। আর শ্রষ্টার কাছে প্রার্থনা, ‘হে আল্লাহ ছোট্টবেলায় মা-বাবা আমাদের যেভাবে লালন-পালন করেছেন তুমিও ঠিক সেভাবে তাদের লালন-পালন করো। আমিন…।’লেখক : সাংবাদিকএইচআর/এমএস/আরআইপি