স্বাস্থ্য

চট্টগ্রামে প্রথমবার অপারেশনে আলাদা হলো জোড়া লাগানো যমজ শিশু

চট্টগ্রামে প্রথমবার অপারেশনে আলাদা হলো জোড়া লাগানো যমজ শিশু

চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো আলাদা করা হলো জন্মগত জোড়া লাগা (কনজয়েন্ট) শিশু। নগরীর অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হাসপাতালে সফল সার্জারির মাধ্যমে দুই শিশুকে আলাদা করা হয়। গত ৭ মে এ সার্জারি হলেও বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি। আগের দিন ৬ মে রিয়াদ জাফর চৌধুরী ও সুরাইয়া ইসলাম দম্পতি জোড়া লাগা যমজ বাচ্চার বাবা মা হন।

Advertisement

অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, জন্মের ২৩ ঘণ্টা পর সফল সার্জারির মাধ্যমে জোড়া লাগানো বাচ্চা দুটোকে আলাদা করা হয়। তিন ঘণ্টার জটিল সার্জারিতে ৮ জন বিশেষজ্ঞ সার্জনসহ ১৮ জনের টিম অংশ নেয়। এটি চট্টগ্রামে প্রথম এবং বাংলাদেশে ৬ষ্ঠ যমজ জোড়া লাগা বাচ্চার সার্জারি। জন্মের সময় বাচ্চাদের ওজন ছিল যথাক্রমে ৯৭৩ ও ১০৪৫ গ্রাম। বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই বাচ্চাদের ওজন রয়েছে ১২৫৫ ও ১৩৫০ গ্রাম।

অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক বলেন, চট্টগ্রামে প্রথমবারের মত জন্মগত জোড়া লাগানো (কনজয়েন্ট) যমজ শিশুর সফল অপারেশন সম্পন্ন করেছে অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হাসপাতাল। এটি আমাদের জন্য খুব আনন্দের বিষয়। এটি খুবই জটিল অপারেশন। চট্টগ্রামে এই প্রথম এ ধরনের সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে। অপারেশনের পর বাচ্চা দুটি সুস্থ আছে। চট্টগ্রামে বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বাচ্চা দুটি সুস্থভাবে বাঁচাতে পারলে আমাদের সে প্রচেষ্টা সফল হবে বলে মনে করি।

হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাফিদ নবী বলেন, জোড়া লাগা বাচ্চার সার্জারি চট্টগ্রামের মধ্যে এর আগে কেউ চিন্তা করেছেন কি না জানি না। আল্লাহর রহমতে গত কয়েক বছরে অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, শুধু চট্টগ্রামে নয়, বাংলাদেশে অন্যতম সেরা একটি ডিপার্টমেন্ট। আজ আমরা যে জটিল সার্জারি সম্পন্ন করতে পেরেছি, এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হাসপাতাল নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন আজও সেবা বন্ধ চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে  দেশে বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক 

হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আদনান ওয়ালিদ বলেন, এই সার্জারিতে আমরা যে জটিলতার মুখোমুখি হয়েছি সেটি হচ্ছে, এটি আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা। কারণ এই রোগীকে আলাদা করার ফ্যাসিলিটিজ রেডি করা, টিম রেডি করা একটি চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল বাচ্চার বাবা আমাদের ওপর আস্থা রাখছেন, আমরা এখানে এটি করতে পারবো। আর চট্টগ্রামের জন্যই এটি একটি অর্জন। এ ধরনের সার্জারির জন্য আর ঢাকায় কিংবা দেশের বাইরে যাওয়া লাগবে না। আমাদের একটি স্বপ্ন হচ্ছে এই চট্টগ্রামেই আমরা বাচ্চাদের লিভার ট্রান্সপ্লান্ট (প্রতিস্থাপন) করবো। বাংলাদেশের মধ্যে এমন সার্জারির মাধ্যমে আলাদা করা এটি ছয় নম্বর সার্জারি। এছাড়া চট্টগ্রামে এই ধরনের সার্জারি এবারই প্রথম। এর আগে আরও দ্রুততম সময়ের কথা বললে সু্‌ইজারল্যান্ডে ২০১৫ সালে ৮ দিন বয়সী জোড়া লাগা বাচ্চাকে আলাদা করা হয়। আর আমাদেরটা হয়েছে জন্মের ২৩ ঘণ্টা পর। ওইদিক বিবেচনায়ও আমরাই প্রথম। এছাড়া আমাদের এই বাচ্চা দুইজনের প্রধান অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো আলাদা ছিল। বিশেষ করে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, লিভার ও কিডনি আলাদা ছিল। আর বুকের মাঝখান থেকে পেটের ওপরের অংশ পর্যন্ত হাঁড়সহ জোড়া লাগানো ছিল। লিভারের ব্লাড সাপ্লাইটা কমন ছিল। এগুলো আমরা আলাদা করেছি।

গাইনোকোলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. রেশমা শারমিন বলেন, গাইনোকোলজি বিভাগে ভর্তির পর যমজ বাচ্চার পজিশন দেখে সিজারিয়ান অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিই। যমজ বাচ্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে একটি বাচ্চা বের করে আনি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বাচ্চাটি বের করি। কিন্তু এই বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রথম বাচ্চা বের করতে গিয়ে দেখা যায় বাচ্চা দুটি জোড়া লাগানো। বিষয়টি আমরা বাচ্চার পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করি। অবশেষে আমরা বাচ্চা দুটির সফল ডেলিভারি করতে সক্ষম হই। এমনিতে যমজ বাচ্চা কম্প্লিকেটেড (জটিল)। তার ওপর এখানে বাচ্চা দুইজনের বুক জোড়া লাগানো। আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল আল্ট্রার রিপোর্টে এসেছে বাচ্চা দুটো মায়ের কাছ থেকে ব্লাড ফ্লো (রক্ত সরবরাহ) পাচ্ছে না। মেডিকেলের ভাষায় এটাকে আমরা বলি ইন্ট্রাইউটেরিন গ্রোথ রেস্ট্রিকশন (আইইউজিআর)। এখন বাচ্চা যদি মায়ের কাছ থেকে রক্ত না পায়, তাহলে বাচ্চা যে কোনো সময় মারা যেতে পারে।

বাচ্চাদের বাবা রিয়াদ জাফর চৌধুরী বলেন, আমরা সার্জারির জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। এই হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট ও চিকিৎসকরা আমাকে সাহস দিলেন। তবে এই জার্নিতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়েছে আমার স্ত্রী। দুটো বাচ্চার ডেলিভারি হওয়া, মানসিক–শারীরিক ধকল সবকিছু ও নিয়েছে। আমি ছিলাম ব্যাকআপ সাপোর্ট। তবে সবকিছু মিলিয়ে সফলভাবে অবশেষে অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। জোড়া লাগা বাচ্চাদের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের বাচ্চাগুলো আল্লাহর রহমতে ভালো আছে। আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

বাচ্চাদের মা সুরাইয়া ইসলাম বলেন, গর্ভধারনের পাঁচ মাস পর আমি যখন অ্যানোমলি স্ক্যান (আল্ট্রাসনো পরীক্ষা) করাতে যাই, তখন ডাক্তার জানালেন এটা টুইন বেবি। আমি তো আসলে একটা বাচ্চা প্রত্যাশা করেছিলাম, তখন আমার ব্যাপারটা খুশিরই ছিল। ছয় মাস পর পুনরায় আল্ট্রা করার পর ডাক্তাররা জানালেন বাচ্চা জোড়া লাগা হতে পারে। এখানে একটা প্রশ্ন রেখেছেন ডাক্তার। জোড়া লাগা বাচ্চার বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। এই ব্যাপারে আমি কিছু জানতাম না। আমার একটা ফ্রেন্ড ছিল গাইনি ডাক্তার, তার সঙ্গে কথা বলার পরে ও–ই আমাকে বিষয়টি ক্লিয়ার করে জানালো। পরে আমি আরেকজন ডাক্তারকে দিয়ে আল্ট্রা করালাম, উনি একই বিষয় অনুমান করেন।

Advertisement

তিনি বলেন, আমার বাচ্চার যেদিন ডেলিভারি হলো, তার একদিন পর সার্জারিও হলো। আমার বাচ্চারা এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে।

এমডিআইএইচ/কেএসআর/জিকেএস