শৈশবে একই পাড়ায় বেড়ে ওঠা তিন বন্ধু সুবিমল, প্রমথ ও শান্ত চাকমার বন্ধুত্বের বয়স দুই যুগেরও বেশি। স্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনেও অটুট সেই বন্ধুত্ব। পাহাড়ি জেলা রাঙামাটিতে বেড়ে ওঠা এই তিন বন্ধুর এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ কাঁঠাল ও কলা থেকে চিপস তৈরির কারখানা। ‘হিলস বাজার’ নামে গড়ে তোলা নিজেদের ছোট্ট প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন পাহাড়ের এই তিন তরুণ।
Advertisement
মৌসুমী ফল উৎপাদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের সুখ্যাতি বেশ পুরোনো। কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে উৎপাদিত মৌসুমী ফলের প্রায় এক দশমাংশ উৎপাদন হয় তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। বিশেষত পাহাড়ের গ্রীষ্মকালীন ফল আম, কাঁঠাল, আনারস ও বারোমাসি কলার কদর বেশি। দেশজুড়ে চাহিদা থাকলেও বিভিন্ন সময় ন্যায্য মূল্যের অভাব ও ফল বাজারজাতকরণে প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রতি মৌসুমে নষ্ট হচ্ছে পাহাড়ে উৎপাদিত ফলের একটি বড় অংশ। পাহাড়ের ফল পচনরোধ ও নষ্ট না করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বছরজুড়ে অর্থনৈতিক চাকা সচলের উদ্যোগ এবং বাণিজ্যিকভাবে বিস্তারের লক্ষ্যে নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন তিন বন্ধু। শুরু করেছেন কাঁঠাল ও কলার চিপস উৎপাদন। প্রান্তিক পর্যায়ের চাষিদের কাছ ন্যায্যমূল্যে কাঁচামাল হিসেবে কাঁঠাল ও কলা সংগ্রহ করে সেগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে চিপসের কারখানা তৈরি করেছেন রাঙ্গামাটির তিন উদ্যোক্তা।
২০২৪ সালের মে মাসে ‘হিলস বাজার’ নামের কারখানাটি চালুর পর এখন স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে এসব চিপস। এ কাজে সহযোগিতা করছে ‘বৈচিত্র্য ডটকম’ নামের পাহাড়ের একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০২৪ সালের মে মাসে রাঙ্গামাটি জেলা শহরের আসামবস্তি এলাকায় তিন তরুণ উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা, প্রমথ চাকমা ও শান্ত চাকমা ছোট পরিসরে একটি চিপস তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন। কারখানাটির কার্যক্রম শুরু করতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কারিগরি সহায়তা ও ডাচ্ বাংলা ব্যাংক পিএলসি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে। শুরুটা কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরি দিয়ে হলেও ভবিষ্যতে অন্যান্য ফলের চিপস উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ থেকে ‘স্বল্পমূল্যের ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং মেশিনের মাধ্যমে আলু, কলা, আম ও কাঁঠালের গুণগত মান বজায় রেখে উৎকৃষ্টমানের চিপস তৈরির প্রযুক্তি ও কলাকৌশল’ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ নেন রাঙ্গামাটির তিন উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা, প্রমথ চাকমা ও শান্ত চাকমা। গত বছরের মে মাসে ছোট পরিসরে প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে কারখানা গড়ে ভ্যাকুয়াম মেশিনের সাহায্যে কলা ও কাঁঠালের চিপস উৎপাদন করছেন। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় দোকানপাট ও বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে চিপস সরবরাহ করছেন তারা। এছাড়া বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, ফোরামের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও বিপণন করছেন। ২৫ গ্রাম ওজনের প্রতিটি চিপসের প্যাকেটের বাজারে খুচরা মূল্য ৩০ টাকা।
সরেজমিনে চিপস প্রস্তুতকরণ কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, তিন উদ্যোক্তার একজন প্রমথ চাকমাসহ কয়েকজন সহযোগী ভ্যাকুয়াম মেশিনের মাধ্যমে কাঁঠাল ও কলা প্রক্রিয়াজাত করে চিপস তৈরি করছেন। প্রথমে কাঁচামাল হিসেবে কলা ও কাঁঠালকে মেশিনের মাধ্যমে তেলে ভাজার পর সেগুলো আবার মেশিনের মাধ্যমে তেল শুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরপর চিপসে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মসলা মিশিয়ে প্যাকেটিং করে বাজারে সরবরাহের উপযোগী করা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও উদ্যোক্তাদের বন্ধু মোহর চাকমা বলেন, বেশ কয়েকমাস যাবৎ এখানে আমাদের বন্ধুরা কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরির কাজ করছে। আজ আমি নিজেই এসে তাদের চিপস খেয়ে দেখলাম, অনেক সুস্বাদু। কাঁঠাল, কলা যেহেতু আমাদের পাহাড়ি ফল, সেক্ষেত্রে স্বাদটাও অনেক ভালো। এখন অনেকেই তাদের এই চিপস সম্পর্কে জানে না কিংবা খায়নি, তারা খেলে বুঝতে পারবেন চিপসের স্বাদটা কেমন।
বৈচিত্র্য ডটকম ই-কমার্স সাইটের প্রতিষ্ঠাতা পল্লব চাকমা বলেন, আমরা নতুন এই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের উৎপাদিত চিপস সারাদেশে বিতরণ, বিপণন ও প্রচার করছি অনলাইনের মাধ্যমে। তাদের চিপস নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
Advertisement
আরেক প্রতিষ্ঠাতা সাজিদ বিন মিকি বলেন, পাহাড়ে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল ও পণ্য অনলাইনে ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে আমরা দেশজুড়ে সরবরাহ করে থাকি। পাহাড়ে উৎপাদিত কাঁঠাল ও কলার চিপসের চাহিদা বাড়ছে।
হিলস বাজার কারখানার উদ্যোক্তাদের সহযোগী দীপ্ত দে বলেন, রাঙ্গামাটি জেলা শহরের বিভিন্ন মেলা, অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী আমরা চিপস তৈরি করে থাকি। এছাড়া প্রতিদিন প্রায় ২০০-২৫০ প্যাকেট গ্রাহকদের মাঝে বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
হিলস বাজার কারখানার উদ্যোক্তা প্রমথ চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে তৈরি চিপসের কাঁচামাল কাঁঠাল ও কলা স্থানীয় চাষিদের থেকে সংগ্রহ করে থাকি। আমরা দেখেছি পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক ফলমূল বিশেষ করে কলা, কাঁঠাল পচে নষ্ট হয়ে যায়। চাষিরাও ক্ষতির মুখে পড়েন। সে কারণে আমরা এই ফলগুলো প্রক্রিয়াজাত করে চিপস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা প্রথমে ক্ষুদ্র পরিসরে তিনজন বন্ধু মিলে এই উদ্যোগ নিয়েছি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে আমাদের একটা চিপস তৈরির মেশিন দেওয়া হয়েছে এবং আমাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক। স্বল্প পরিসরে আমরা এটি শুরু করলেও ধীরে ধীরে সাড়া পাচ্ছি। আপাতত এসব পণ্য এখানকার স্থানীয় বাজার, মেলা ও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করা শুরু করেছি। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠান বৃহৎ পরিসরে করা গেলে জেলার বাহিরেও বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আরেক উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা বলেন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে তিন বন্ধু প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা কাঁঠালের ওপর বেশি জোর দিয়েছি। যেহেতু কাঁঠাল এক মৌসুমে পাওয়া যায় শুধু। যদি এই কাঁঠালকে আমরা প্রক্রিয়াজাত করে অন্য জিনিসে রূপান্তর করতে পারি, তাহলে সারাবছর কাঁঠালের স্বাদটা নিতে পারবে মানুষ। ভবিষ্যতে বৃহৎ আকারে শুরু করা গেলে চিপসের পাশাপাশি জুস, জেলিসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যও তৈরি করবো।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি অ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, কাঁঠাল ও কলা থেকে চিপস তৈরি রাঙ্গামাটিতে সম্ভাবনাময় এক নতুন উদ্যোগ। এ ধরনের উদ্যোক্তারা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে আমরা তাদেরকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ পেতে সহায়তাসহ পরামর্শ দিয়ে থাকি। পাহাড়ে এ ধরনের উদ্যোগ আরও বেশি বিকাশিত করতে আমরাও উদ্যোক্তাদের পাশে থাকতে চাই।
এফএ/জেআইএম