মতামত

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আলেমসমাজ: একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আলেমসমাজ: একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধর্মীয় চর্চার আঙ্গিনায় এক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ভিত্তিক ইসলাম প্রচার। ধর্মীয় অনুশীলনের এই যে রূপান্তর, তা শুধু মাধ্যমগত পরিবর্তন নয়, বরং এটি ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে এক নতুন সামাজিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। যাদেরকে আমরা ‘ডিজিটাল আলেম’ হিসেবে অভিহিত করতে পারি, তাদের উত্থান এবং ক্রমবর্ধমান প্রভাব সমাজতাত্ত্বিকভাবে অনুধাবন করার জন্য দুটি তাত্ত্বিক কাঠামো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ: একটি হলো ‘মিডিয়াটাইজড রিলিজিয়ন’ (Mediatized Religion) বা গণমাধ্যম প্রভাবিত ধর্মতত্ত্ব এবং ‘পোস্ট-ওয়েবেরিয়ান’ (Post-Weberian) কর্তৃত্বের ধারণা।

Advertisement

এই দুটি তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কীভাবে বাংলাদেশি আলেমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লাখ লাখ অনুসারী তৈরি করে ধর্মীয় কাঠামোর পুনর্গঠন করছেন, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এবং প্রবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

মিডিয়াটাইজড রিলিজিয়ন তত্ত্ব অনুযায়ী, গণমাধ্যম কেবল ধর্মের বাহন হিসেবেই কাজ করে না; এটি ধর্মীয় বার্তা ও অভিজ্ঞতা নিজস্ব যুক্তি, বিন্যাস এবং কাঠামোর মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে রূপান্তর করে। মিডিয়ার এই প্রভাব ধর্মকে শুধু পরিবেশন করে না, বরং ধর্মীয় বার্তা প্রদান ও অনুশীলনের পদ্ধতিকেও মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে।

বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে ইসলামি ওয়াজ বা ধর্মীয় আলোচনা সাধারণত মসজিদ, মাদরাসা কিংবা উন্মুক্ত ময়দানের মাহফিলকেন্দ্রিক হয়। সেখানে একজন আলেমের ধর্মীয় কর্তৃত্ব নির্ধারিত হয় তার পাণ্ডিত্য, শরিয়াহ্ সম্পর্কিত গভীর জ্ঞান এবং সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমের আগমনে এই চিরায়ত ধারায় সুস্পষ্ট পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে।

Advertisement

বর্তমানে ইউটিউব এবং ফেসবুকে বহু আলেম ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, মুফতি গিয়াস উদ্দিন তাহেরি, শাইখ আহমাদুল্লাহ কিংবা মিজানুর রহমান আজহারীর মতো ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা যায়। তাদের ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলে লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে, প্রতিটি ভিডিওতে হাজার হাজার লাইক ও মন্তব্য জমা হয় এবং তারা নিয়মিতভাবে তাদের অনুসারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর প্রদানের মাধ্যমে এক নতুন ধরনের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।

তারা কেবল শরিয়াহর গণ্ডিবদ্ধ আলোচনায়ই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছেন না, বরং আধুনিক জীবনের নানাবিধ বাস্তবতা—যেমন পারিবারিক সংকট, প্রবাস জীবনের নানাবিধ চ্যালেঞ্জ, আর্থ-সামাজিক সমস্যা, এমনকি রাজনৈতিক টানাপোড়েন— এসব বিষয়েও বিশদ আলাপ করছেন। তাদের এই ধর্মীয় বার্তা একদিকে যেমন ইসলামি মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার প্রয়াস চালায়, তেমনই অন্যদিকে ডিজিটাল যুগের চাহিদা, ভাষা ও কাঠামোর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়।

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের কর্তৃত্ব তত্ত্বে ধর্মীয় কর্তৃত্বকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে— ঐতিহ্যগত কর্তৃত্ব (Traditional Authority), আইনগত-যৌক্তিক কর্তৃত্ব (Legal-Rational Authority) এবং ক্যারিশমাটিক বা সম্মোহনী কর্তৃত্ব (Charismatic Authority)। কিন্তু ডিজিটাল আলেমদের কর্তৃত্বকে এই গতানুগতিক শ্রেণিবিভাগের ছাঁচে পুরোপুরি ফেলা কঠিন। পোস্ট-ওয়েবেরিয়ান তাত্ত্বিকরা মনে করেন, আধুনিক যুগে কর্তৃত্বের ধারণা অনেকটাই সংকর বা হাইব্রিড প্রকৃতির। ডিজিটাল আলেমরা একদিকে যেমন কোরআন-হাদিস ও শরিয়াহভিত্তিক ঐতিহ্যগত জ্ঞানের ওপর নির্ভর করেন, তেমনই অন্যদিকে তাদের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, বাগ্মিতা এবং মিডিয়ার যৌক্তিক কাঠামো (যেমন—কনটেন্ট নির্মাণ, বিপণন) ব্যবহার করে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন। তাদের অনেকেরই ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাতিষ্ঠানিক সনদ বা ডিগ্রি রয়েছে, কিন্তু তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি হলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তাদের অগণিত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা, যা পরিমাপ করা হয় ভিউ, শেয়ার এবং মন্তব্যের মাধ্যমে।

এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় কর্তৃত্ব ক্রমশ ভিজ্যুয়াল (দৃশ্যমান), পারফরমেটিভ (পরিবেশনমূলক) এবং অংশগ্রহণমূলক (interactive) হয়ে উঠছে। ডিজিটাল আলেমরা তাদের ধর্মীয় আলোচনা বা বয়ানগুলো আকর্ষণীয়ভাবে সম্পাদনা করেন, দর্শকদের বোঝার সুবিধার্থে সাবটাইটেল যুক্ত করেন, এবং ভিডিওর থাম্বনেইল ও শিরোনামে আকর্ষণীয় উপাদান ব্যবহার করেন, যাতে দর্শকের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। তারা প্রায়শই ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলেন।

Advertisement

ফলে দর্শক অনুভব করেন যেন আলেম ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গেই কথা বলছেন। অনেকেই ফেসবুক লাইভে এসে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন অথবা ইউটিউবের কমেন্ট সেকশনে সক্রিয়ভাবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এই দ্বিমুখী ও অংশগ্রহণমূলক যোগাযোগ ব্যবস্থা ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানকে একতরফা বক্তৃতার পরিবর্তে একটি প্রাণবন্ত সংলাপে রূপান্তরিত করেছে।

ধর্মচর্চার এই নবতর মাধ্যমটি তরুণ প্রজন্মের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। অনেক তরুণই মসজিদের চিরায়ত খুতবা বা মাদরাসার কাঠামোগত ও আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা থেকে নিজেদের কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখে, কারণ প্রচলিত পদ্ধতিকে তারা অনেক সময় কঠোর, দূরবর্তী এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে কম প্রাসঙ্গিক বলে মনে করে।

কিন্তু ডিজিটাল আলেমরা যখন টিকটক, প্রেম-ভালোবাসা, হালাল বিনোদন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চাকরি বা প্রবাস জীবনের কঠিন বাস্তবতাগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেন, তখন তরুণ প্রজন্ম সেই বিষয়গুলোর সঙ্গে নিজেদের সহজেই একাত্ম করতে পারে। এই নতুন রূপে আলেমরা একাধারে ধর্মীয় পথপ্রদর্শক এবং অন্যদিকে সমসাময়িক সংস্কৃতি-সচেতন পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

একদিকে যেমন ধর্মীয় ব্যাখ্যার অগভীরতা ও বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে যে কেউ সামান্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করে নিজেকে ‘আলেম’ বা ধর্মীয় জ্ঞাতা হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে ভুল তথ্য, বিকৃত ব্যাখ্যা এবং গুজব ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। উপরন্তু ধর্মীয় মতপার্থক্য এবং বিভাজনমূলক বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব সহজে ভাইরাল হতে পারে, যা সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ হতে পারে।

বিশেষভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনে এই ডিজিটাল আলেমদের গুরুত্ব অপরিসীম। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইউরোপ বা আমেরিকার মতো দূর দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিক, ছাত্র এবং পেশাজীবীরা প্রায়শই আত্মিক নিঃসঙ্গতা, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা এবং ধর্মীয় পরিচিতি সংকটের মুখোমুখি হন। তারা তখন ইউটিউবে তাদের প্রিয় আলেমের ওয়াজ বা আলোচনা শুনে মানসিক প্রশান্তি লাভ করেন, নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় টিকিয়ে রাখার প্রেরণা পান এবং এক ধরনের ডিজিটাল উম্মাহ বা বৈশ্বিক মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশীদারত্ব অনুভব করেন। ফেসবুক গ্রুপ এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই ভিডিওগুলো দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা প্রবাসীদের মধ্যে একটি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সংযোগ তৈরি করে। এক্ষেত্রে আলেম শুধু ধর্ম প্রচারকের ভূমিকায়ই সীমাবদ্ধ থাকেন না, বরং তিনি হয়ে ওঠেন একজন নৈতিক বন্ধু, পরিবার-পরিজনহীন প্রবাসী মুসলিমদের আত্মিক আশ্রয়।

তবে ধর্মীয় আঙ্গিনায় এই রূপান্তর বেশ কিছু বিতর্ক ও উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে। অনেক ঐতিহ্যবাহী ও প্রবীণ আলেম এবং রক্ষণশীল ইসলামি প্রতিষ্ঠান এই ডিজিটাল আলেমদের উত্থানকে সন্দেহের চোখে দেখেন এবং কখনো কখনো তাদের ‘অগভীর’, ‘চটকদার’ ও ‘মূল ধারা থেকে বিচ্যুত’ বলে সমালোচনা করেন। তাদের প্রধান অভিযোগ হলো, এই ডিজিটাল মাধ্যমে পরিবেশিত ধর্মীয় শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রে অগভীর, পাণ্ডিত্যহীন, অতিমাত্রায় সরলীকৃত এবং প্রায়শই ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যায় পরিপূর্ণ। তবে, এই ধরনের সমালোচনা ডিজিটাল আলেমদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর কারণ হলো, তাদের কর্তৃত্ব মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ব্যাপক অনুমোদন এবং সমর্থনের ওপর প্রতিষ্ঠিত, কোনো প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ওপর নয়। অনেক সময় এই আলেমরা বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন, যা paradoxically তাদের ভিউ, সাবস্ক্রাইবার এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে, তাদের পরিচিতি আরও বাড়িয়ে দেয়।

এছাড়া এই আলেমরা মিডিয়ার অন্তর্নিহিত গাণিতিক ও বাণিজ্যিক কাঠামোর সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা এমন সব বিষয়ে কনটেন্ট তৈরি করছেন এবং এমন সব শিরোনাম ব্যবহার করছেন, যা সহজেই দর্শকদের আকৃষ্ট করে এবং ভাইরাল হতে সহায়ক। যেমন: ‘নারীরা কি চাকরি করতে পারবে?’, ‘প্রেম করা হারাম না হালাল?’, ‘মেয়েদের ছবি বা ভিডিও তোলার অধিকার কি ইসলামে আছে?’ এই ধরনের বিষয়বস্তু একদিকে যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনই অন্যদিকে এগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রাখে। ধর্মীয় জ্ঞানের উপস্থাপনা এখানে ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট, আবেগঘন বা নাটকীয় কণ্ঠস্বর, প্রাসঙ্গিক ইসলামিক আবহ সংগীত ইত্যাদির সমন্বয়ে আরও বেশি প্রভাববিস্তারী হয়ে ওঠে। ধর্মের কণ্ঠস্বর এখন ক্যামেরা, এডিটিং সফটওয়্যার এবং ইউটিউব অ্যালগরিদমের জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত ও পরিমার্জিত হচ্ছে।

এই সামগ্রিক পরিবর্তনের মাঝে কিছু আশঙ্কার দিকও বিদ্যমান। একদিকে যেমন ধর্মীয় ব্যাখ্যার অগভীরতা ও বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে যে কেউ সামান্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করে নিজেকে ‘আলেম’ বা ধর্মীয় জ্ঞাতা হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ পাচ্ছেন। এর ফলে ভুল তথ্য, বিকৃত ব্যাখ্যা এবং গুজব ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। উপরন্তু, ধর্মীয় মতপার্থক্য এবং বিভাজনমূলক বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব সহজে ভাইরাল হতে পারে, যা সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ হতে পারে। তথাপি, এ কথা অনস্বীকার্য যে, মিডিয়া যখন ধর্মের গঠন, আঙ্গিক এবং গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড পরিবর্তন করে, তখন ধর্মীয় কর্তৃত্বও হয়ে ওঠে আরও বেশি অস্থিতিশীল, আলাপ-আলোচনা নির্ভর এবং প্রযুক্তিনির্ভর।

বাংলাদেশের ধর্মীয় বাস্তবতা বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে প্রবেশ করেছে, যেখানে মসজিদের মিম্বর আর ইউটিউবের পর্দা একযোগে সহাবস্থান করছে। ধর্মীয় জ্ঞান এখন আর শুধু কিতাব, মসজিদ বা মাদরাসার চার দেওয়ালে আবদ্ধ নয়; বরং তা বহুলাংশে ফেসবুকের কমেন্ট সেকশন, ইউটিউবের ভিউ কাউন্ট এবং সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যার ওপরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এই জটিল পরিবর্তনকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য আমাদের ধর্মতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বে নতুন ধরনের বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতির প্রয়োজন, যা মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মধ্যে ধর্ম ও কর্তৃত্বের আন্তঃসম্পর্ককে স্পষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারবে।

সার্বিকভাবে, বাংলাদেশে ডিজিটাল আলেমদের উত্থান আসলে ধর্মীয় কর্তৃত্ব, জ্ঞানচর্চা এবং অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এক নতুন সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন। এই বাস্তবতায় প্রথাগত ও আধুনিক, স্থির ও গতিশীল, মসজিদ ও মোবাইল—এই আপাতবিরোধী উপাদানগুলো মিলেমিশে এক ভিন্নধর্মী ধর্মীয় সমাজ বিনির্মাণ করছে। এই পরিবর্তনের যেমন কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনই কিছু নেতিবাচক দিকও উপেক্ষা করার মতো নয়।

তবে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বাংলাদেশে ইসলামের আধুনিক রূপায়ণ এবং ধর্মীয় বক্তৃতা বর্তমানে এক বিশাল ‘স্ক্রলিং উম্মাহ’ (Scrolling Ummah) বা নিরন্তর ডিজিটাল কনটেন্ট ব্রাউজকারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে। ধর্মের এই বিস্তৃত ডিজিটাল পরিসরে আলেমের ভূমিকাও আমূল পরিবর্তিত হয়েছে—তিনি আর কেবল মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে থাকা ইমাম নন, বরং তিনি ইউটিউবের ‘লাইভ’ বক্তা, ফেসবুকের ভাইরাল ভিডিওর কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং দূর প্রবাসে থাকা নিঃসঙ্গ মুসলমানের একাকিত্বের সঙ্গী ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। এই বহুমাত্রিক ভূমিকাই আজকের বাংলাদেশের ডিজিটাল আলেমদের স্বতন্ত্র পরিচিতি দান করেছে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/জেআইএম