তিন দশক ধরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলে আসছেন, দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় বহিঃশত্রু হলো ইরান। বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি। ছোট তবে ঘনবসতিপূর্ণ ইসরায়েল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে। ফলে ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়, তাহলে ইসরায়েলের অস্তিত্বই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
Advertisement
এই বিশ্বাস থেকেই শুক্রবার (১৩ জুন) ভোররাতে নেতানিয়াহু হামলার সিদ্ধান্ত নেন। একের পর এক যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ইরানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হয়। লক্ষ্য ছিল রাজধানী তেহরান থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো এবং অস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা। হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মহাম্মদ বাঘেরিসহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা নিহত হন।
একসময় নেতানিয়াহু ছিলেন ঝুঁকি এড়াতে অভ্যস্ত এক নেতা। কিন্তু এই হামলা ছিল অতিমাত্রায় দুঃসাহসিক, এমনকি বেপরোয়া বললেও কম বলা হবে। তিনি মনে করেন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে ইসরায়েলের এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনও রয়েছে তার পক্ষে। যদিও এই হামলা ইরানি শাসনব্যবস্থার ওপর এক বড় ধাক্কা হতে পারে, তবুও এর ফলাফল জটিল এবং বহুমাত্রি। যার মধ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নেতিবাচক দিকও রয়েছে।
ইরান পুরো অঞ্চলে বিভিন্ন গোষ্ঠী, সশস্ত্র মিলিশিয়া ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে, যার মধ্যে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকারও রয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনেয়ী বারবার ইসরায়েল ধ্বংসের হুমকি দিয়েছেন।
Advertisement
যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেয়ে যায়, তাহলে এ হুমকি বহুগুণ বেড়ে যাবে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্র, যেমন সৌদি আরবও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া এমন ইরানকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)-এর স্বাধীনতা সীমিত হয়ে যেতে পারে, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তা কাঠামোকে দুর্বল করে তুলবে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে এই মুহূর্তটাই ছিল বড় সুযোগ। বর্তমানে ইরান তার ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে লেবানন ও সিরিয়ায় তাদের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে এবং হিজবুল্লাহর মতো প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীও আর বড় ধরনের পাল্টা আঘাত হানার সক্ষমতা রাখে না।
এক ভাষণে নেতানিয়াহু জানান, ইরান এরই মধ্যে অস্ত্রায়নের পথে অগ্রসর হয়েছে এবং তারা একটি পারমাণবিক যন্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে। তিনি মনে করেন, আমেরিকার সঙ্গে আলোচনার আড়ালে ইরান গোপনে নিজের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।
আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে—এমন আশাবাদ রয়েছে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের হত্যার ফলে তেহরানে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে এবং তাৎক্ষণিক পাল্টা জবাব দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে ইরান।
Advertisement
তবে এই অপারেশন ছিল অত্যন্ত ঝুঁকির। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা মার্চ মাসে বলেছে, আয়াতোল্লাহ খামেনেয়ী ২০০৩ সালে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন এবং এখনও তা পুনরায় অনুমোদন দেননি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হামলার পরও ইরানকে আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানান। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে মতপার্থক্য আরও গভীর হতে পারে।
এদিকে ইরানও ইসরায়েলে পাল্টা হামলা শুরু করেছে। তারা উপসাগরীয় দেশগুলোতেও হামলা চালাতে পারে, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদেরও ইরান অস্ত্র ও সমর্থন দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলি বা ইহুদি স্বার্থেও সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। আর একটি পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হলে তা বিশ্বজুড়ে তেলের দাম ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
আরও ভয়ঙ্কর এক আশঙ্কা হলো ইরানের শাসনব্যবস্থা যদি হঠাৎ ভেঙে পড়ে তাহলে দেশটি চরম বিশৃঙ্খলায় পড়ে যাবে। একটি জটিল রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা নেই। ফলে সেখানে কী ধরনের রাজনৈতিক শক্তি উঠে আসবে, তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না।
সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হতে পারে। ইরাক (১৯৮১) ও সিরিয়ার (২০০৭) পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল সফলভাবে হামলা চালালেও ইরানের কর্মসূচি অনেক বেশি বিস্তৃত ও সুসংগঠিত। বিশেষ করে ফরদো অঞ্চলের ইউরেনিয়াম স্থাপনাটি একটি পর্বতের নিচে অবস্থিত, যা ইসরায়েলি হামলার নাগালের বাইরে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা ধ্বংস করতে হলে হয়তো মার্কিন সহায়তা বা স্থল অভিযানের প্রয়োজন হবে। এমনকি অবকাঠামো ধ্বংস হলেও, ইরানের নিজস্ব ইউরেনিয়াম মজুদ ও প্রযুক্তি রয়েছে, যা সহজে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
নেতানিয়াহু অবশ্য বলছেন, তার দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য অপেক্ষা করার বিলাসিতা ইসরায়েল করতে পারে না।
যদি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে নেতানিয়াহুর কৌশলকে সার্থক বলা যাবে। কিন্তু তা যদি না হয়, তাহলে এই পদক্ষেপই ইসরায়েলকে আরও বড় সংকটে ফেলতে পারে। যখন উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের চেষ্টা করছে, তখন নেতানিয়াহুর সংঘাতকামী কৌশল সেই সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ইরানি আগ্রাসন থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি হয়তো গোটা অঞ্চলকে নতুন করে সহিংসতার চক্রে ফেলে দিলেন—যা শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
এমএসএম