অর্থনীতি

জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার শঙ্কা, স্বল্পোন্নত দেশের ঝুঁকি বেশি

জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার শঙ্কা, স্বল্পোন্নত দেশের ঝুঁকি বেশি

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। এরই মধ্যে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর হরমুজ প্রণালি বন্ধের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দেশটির সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদন লাগবে।

Advertisement

বৈশ্বিক জ্বালানি বাণিজ্যের ২০ শতাংশ তেল (দিনে গড়ে দুই কোটি ব্যারেল) এবং প্রায় ৩০ শতাংশ এলএনজি এই পথ দিয়েই পরিবহন করা হয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পড়বে বহুমাত্রিক প্রভাব। চরম অস্থিরতায় বাড়বে জ্বালানির দাম।

হরমুজ প্রণালি বন্ধের ঝুঁকিতে বৈশ্বিক জ্বালানি ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মো. নাহিদ হাসান।

আরও পড়ুন:

Advertisement

হামলা চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক জ্ঞান ‘ধ্বংস করা যাবে না’হরমুজ প্রণালি বন্ধের পক্ষে ইরানের পার্লামেন্ট বাংলাদেশেও বাড়তে পারে জ্বালানি তেলের দাম, এলএনজি পেতে শঙ্কা ইরান-ইসরায়েল সংঘাত, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লো 

জাগো নিউজ: ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে কী প্রভাব পড়বে?

ড. ইজাজ হোসেন: হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা বাড়বে। এখন কথা হচ্ছে ওদের (ইরান) কতখানি ক্ষমতা আছে এটিকে বন্ধ রাখার। তখন ইউরোপসহ অন্য দেশও আমেরিকার সঙ্গে কথা বলে এটিকে খোলা রাখার চেষ্টা করবে। কিছুদিনের জন্য খুবই খারাপ অবস্থা হয়ে যাবে। তেলের দাম তখন সাংঘাতিক রকম বেড়ে যাবে। এখন ইরানকে সাপোর্ট দিয়ে অন্য দেশ যদি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় তখন খুব জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে। এটা বলা ডিফিকাল্ট যে আমেরিকা কতখানি এগুলোকে প্রতিহত করবে। আবার ইরান যদি একেবারে সিদ্ধান্ত নেয় যে এটিকে তারা বন্ধ করবেই তখন আমেরিকা জোটভুক্ত দেশকে সঙ্গে নিয়ে এটিকে ভাঙার চেষ্টা করবে।

আমরা ঝুঁকিতে পড়ে যাবো। এরকম পরিস্থিতিতে স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ভালো থাকতে হয়। এটি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময়ও মেনশন করি।

তবে আমি মনে করি এটা বেশি দিন বন্ধ রাখতে পারবে না, অন্যান্য ফ্যাক্টর চলে আসবে। কিন্তু যতদিনই বন্ধ থাকুক সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হবে। তেল পরিবহনে এই প্রণালি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস। আমরা বেশিরভাগ তেল আনি সিঙ্গাপুর থেকে। আবার সিঙ্গাপুর ওখান থেকে আনে। এজন্য একটা সমস্যা তৈরি হবে। এটা অনুমান করা জটিল।

Advertisement

আরও পড়ুন:

ইরানে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের হামলায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশপুতিনের সঙ্গে ‘গুরুতর আলোচনায়’ বসছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীহরমুজ প্রণালি চালু রাখতে চীনের দ্বারস্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ এই পথ দিয়েই কাতার থেকে এলএনজি আনে। এখন সরবরাহ ঘটতি হলে আমাদের সংকট বাড়বে। আপনার কী মনে হয়?

ড. ইজাজ হোসেন: আমরা ঝুঁকিতে পড়ে যাবো। এরকম পরিস্থিতিতে স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ভালো থাকতে হয়। এই স্টোরেজ ফ্যাসিলিটির কথা আমরা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় মেনশন করেছিলাম। আরেকটি বিষয় আমাদের তৃতীয় এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট) যেটা বাতিল করা হলো, সেটি থাকলেও তার একটা প্রসেসিং ক্যাপাবিলিটি থাকতো। এটি থাকলে আমরা গ্যাস প্রসেসিং করে রাখতে পারতাম। এ ধরনের সিচুয়েশনে দুই সপ্তাহ ভালো সময়। কিন্তু আমরা দেশের সব কিছু তো দুই সপ্তাহ বন্ধ রাখতে পারি না। যদিও আমাদের নিজস্ব গ্যাস আছে। এজন্য গ্যাস সরবরাহ আমাদের জিরো হয়ে যাবে না। কিন্তু তেল জিরো হয়ে যেতে পারে যদি আমাদের দেশে ৪৫ দিনের কম তেল মজুত রাখা হয়। এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় মজুত কমে ১৫ দিনে নেমে এসেছিল। এজন্য দুটোরই মজুত বাড়ানো উচিত। মজুত থাকলে একটা সিকিউরিটি থাকে। আবার যখন দাম কম থাকে তখন কিনে সেটাকে স্টোরেজ করা যায়। এটা স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর। আমরা অনেক আগে থেকেই জ্বালানির স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বাড়ানোর কথা বলছি কিন্তু করা হয়নি। আমাদের অবশ্যই স্টোরেজ ক্যাপাসিটি নিয়ে চিন্তা করা উচিত।

তারা (ইরান) নিজেরাও সংকটে পড়বে। ওদেরও তেল বিক্রি করা দরকার। সেজন্য আমার মনে হয় না এটা বেশিদিন বন্ধ থাকবে।

আরেকটি বিকল্প হলো এখানে আমেরিকা থেকে গ্যাস কেনা যায়। যদিও আমেরিকা অনেক দূরে কিন্তু সেখানকার গ্যাস সস্তা। আমরা সেখানেও কার্গো বুক করে রাখতে পারি। এমনও হতে পারে একটা আমেরিকা থেকে এলো আরেকটি হরমুজ প্রণালি হয়ে এলো। তাহলে অন্তত সিকিউরিটি থাকে।

আরও পড়ুন:

তেহরান থেকে আগামী সপ্তাহেই ফিরতে শুরু করবে বাংলাদেশিরাইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ধস

জাগো নিউজ: ওপেকভুক্ত (আলজেরিয়া, গ্যাবন, বিষুবীয় গিনি, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, নাইজেরিয়া, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনেজুয়েলা) তেল উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে ইরান তৃতীয়। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে ইরান তো নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

ড. ইজাজ হোসেন: এটা ঠিক যে তারা নিজেরাও সংকটে পড়বে। ওদেরও তেল বিক্রি করা দরকার। সেজন্য আমার মনে হয় না এটা বেশিদিন বন্ধ থাকবে। এটা হুমকি হতে পারে। সেজন্য আমি বলেছিলাম দুই সপ্তাহ। এ সময়ের মধ্যে একটু ফাইটিং সিচুয়েশন হতে পারে। এরপর আবার স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। কেননা ইরানেরও তেল সরবরাহের পথ এটাই।

দাম বাড়লে উন্নত দেশের গায়ে লাগে না, আমরা একচুয়ালি প্রাইসেই আটকে যাই।

জাগো নিউজ: আপনার কি মনে হয় এমন পরিস্থিতিতে উন্নত দেশের তুলনায় স্বল্পোন্নত বা অনুন্নত দেশ বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারে?

ড. ইজাজ হোসেন: চাহিদা এবং জোগানের তারতম্যের কারণে এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। উন্নত দেশের চাহিদা অনেক। তাদের উচ্চ চাহিদার মধ্যে জোগান একটু কম হয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশের জ্বালানির চাহিদা কম, এই কম চাহিদার মধ্যে একটু কমে গেলে বিরাট তফাত দেখা দেয়। এজন্য আমাদের জন্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। আর দাম বাড়লে উন্নত দেশের জন্য দুই মাস ছয় মাস গায়ে লাগে না। কারণ সেই ক্ষমতা তাদের আছে। আমাদের সেটি নেই। আমরা একচুয়ালি প্রাইসেই আটকে যাই।

এনএস/এসএনআর/এমএমএআর/জেআইএম