রাজশাহী নগরীর দাসপুকুরের বাসিন্দা এনামুল হক। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকোর) প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন। সম্প্রতি তিনি লক্ষ্য করেছেন প্রিপেইড মিটারে তাকে মাসে ভাড়া দিতে হচ্ছে ৪০ টাকা। প্রতি মাসেই এই ভাড়া দিতে হচ্ছে। এতে বেশ ক্ষিপ্ত তিনি।
তিনি বলেন, আমার বাড়িতে প্রিপেইড মিটার হঠাৎ করেই লাগিয়ে দেয় নেসকো। কোনো কিছু না বলেই একদিন বাড়িতে এসে দেখি তারা এটি লাগিয়ে দিয়ে গেছে। এমনকি আমার পুরাতন মিটারও তারা খুলে নিয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো আগের মিটার তো আমার টাকা দিয়ে কেনা। তাহলে আমার মিটার নিয়ে এই মিটার লাগিয়ে দিয়েছে তারপরও কেন তারা ভাড়া নিচ্ছে? এটা অন্যায়। আমার মিটারও আমাকে দেবে না আবার তাদের দেওয়া মিটারেরও ভাড়া নেবে। এটি কীভাবে হয়।
একই এলাকার বাসিন্দা নাসির আলী। তিনি বলেন, আমার বাড়িতে এখনো নেসকোর প্রিপেইড মিটার লাগানো হয়নি। যে কারণে আমার বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে এখন ভাড়া কাটা হয় না।
নাসির আলী আর এনামুল হক দুজনই নেসকোর গ্রাহক। তাদের মতো হাজার হাজার গ্রাহকের সঙ্গে করা হচ্ছে এমন ‘বৈষম্য’। তবে এনামুলের মতো অনেক গ্রাহক নিজের কেনা মিটারের পরিবর্তে পাওয়া প্রিপেইড মিটারের ভাড়া গুনছেন। এভাবে মাসে গড়ে ২৭ কোটি টাকা ভাড়া উত্তোলন করছে নেসকো।
নেসকোর প্রিপেইড মিটার কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের ৬ লাখ ৭০ হাজার প্রিপেইড মিটার লাগানো হয়েছে। প্রতি মাসে এসব মিটারের দুই ফেইজের সংযোগের জন্য ৪০ টাকা ও থ্রিফেইজের সংযোগের জন্য ২৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। গড়ে প্রতি মাসে মিটার ভাড়া খাত থেকে তারা ২৭ কোটি টাকা উত্তোলন করছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, মিটার লাগতে যে টাকা খরচ হয়েছে সেটির লোন শোধের জন্য এটি করা হচ্ছে।
গ্রাহকদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হলেও এর মাসিক ভাড়া ও অন্যান্য চার্জ নিয়ে স্বচ্ছতা নেই। এমনকি একই এলাকায় কারো কাছে নেওয়া হচ্ছে ভাড়া আবার কারো কাছে নেই ভাড়া।
অনেকে বলছেন, মিটার ভাড়া আদায় করা অযৌক্তিক, কারণ মিটার বসানো সরকারের একটি সেবা কার্যক্রম।
রাজশাহী মহানগরের সাহবে শিরোইলের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম জানান, প্রিপেইড মিটারে বিদ্যুৎ খরচ ঠিকমতো মাপা যাচ্ছে, এটা ভালো। কিন্তু ভাড়া কেন কাটা হচ্ছে, সেটা আমরা বুঝতে পারছি না। বিদ্যুৎ কিনেই ব্যবহার করি, মিটারের জন্য আবার মাসে মাসে টাকা দিতে হবে এটা অবিচার। এসব মিটার তো আমার আগের টাকা দিয়ে কেনা মিটারের পরিবর্তেই দেওয়া হয়েছে। তাহলে ভাড়া দেবো কেন?
এ বিষয়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে নেসকোর আওতাধীন এলাকায় স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন প্রকল্প পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, প্রিপেইড মিটার বসানোর খরচ পুরোপুরি সরকার বহন করছে না। মিটারের যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচও আছে। সেজন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে নামমাত্র ভাড়া নেওয়া হয়। এটি আগেও ছিল। সরকার নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। সেটি আমরা কার্যকর করছি।
তিনি আরও বলেন, একটি মিটারে ৬ হাজার টাকা করে খরচ হয়। তবে কেউ চাইলে এই মিটারের দাম একবারেই দিতে পারেন। আবার কেউ চাইলে এই মিটার ভাড়াও রাখতে পারবে। একেবারে চাইলে এটির জন্য কোনো গ্যারান্টি হবে না। আর ভাড়া দিলে এটি আমাদের দায়িত্বে থাকবে। এসব মিটারের আয়ুকাল এত বেশি নয়। যে কারণে একটি মিটারে ভাড়া শোধ হতে হতে ১১ বছর সময় লাগবে। এটির ভাড়া সরকার চাইলে আমরা ফ্রি করে দিতে পারি। তবে লোন শোধের জন্যই এটি করা হয়েছে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে সব গ্রাহকেই আমরা প্রিপেইড মিটারে যাবো। তখন বৈষম্যটা থাকবে না।
তিনি দাবি করেন, গ্রাহকের আগের মিটার নেওয়া হয় না। কোনো গ্রাহক চাইলে সেটি ফেরত দেওয়া হবে।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, শুরু থেকে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ আপত্তি জানিয়েছে। তাদের কাছে অভিযোগ করেছে। কিন্তু তৎকালীন সরকারের ক্ষমতাবান নেতাকর্মীদের নিয়ে তারা জোর করে এটি লাগিয়ে দিয়েছে। তখন ভয়ে অনেকেই কথা বলেনি। যে মিটারগুলো তারা দিয়েছে সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ। বন্ধ হয়ে গেলেও তারা ঠিক করে না। আমি মনে করি এই ত্রুটিপূর্ণ মিটার বাদ দিয়ে আমাদের যার যার মিটার তাকে দিয়ে দেওয়া হোক। এটি না হলে আমরা আন্দোলনে নামবো।
তিনি আরও বলেন, শুধু ভাড়া নয়। তারা ভ্যাট, ট্যাক্স কাটছে। এগুলো মানুষ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
সাখাওয়াত হোসেন/জেডএইচ/এমএস