অন্যের জমিতে ফসল চাষে সুখ খোঁজেন গফুর

সাদিকুল ইসলাম সাদিক
কাঁধে ধানের ভার নিয়ে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটেন গফুর মিয়া। দিনের আলো মিলিয়ে সন্ধ্যা নামলেও থেমে নেই মাঠের উৎসব। কাঁচির ক্যাচ ক্যাচ শব্দ আর ভাওয়াইয়ার সুরে জমে ওঠে ফসল কাটার উৎসব। এ যেন অন্যরকম অনুভূতি। যেখানে সময়ের হিসাবও হারিয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বছর ঘুরে এপ্রিল-মে মাসে গ্রামবাংলায় বোরো ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়। এ মৌসুমের সূচনা ঘটে আমন মৌসুম শেষ হওয়ার পরপরই। ধান রোপণ শুরু হয় বাংলা কার্তিক-অগ্রহায়ণ (অক্টোবর-নভেম্বর) মাসে। ধান কাটা চলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-জুন) পর্যন্ত। হেমন্তের শুরু থেকে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলা এ ধানের ফলন বসন্তকালে হয়। তাই একে ‘বাসন্তিক ধান’ বলেও ডাকা হয়।
সময়টা গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোর জন্য এক উৎসব। ছয় মাস রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে কাজ করার পর যখন ধান কাটার সময় আসে; তখন শুধু ধান নয়—কাটা হয় এক ধরনের সুখ, এক ধরনের স্বস্তি। সাধারণত পুরুষেরা দলবেঁধে মাঠে ধান কাটেন। যারা জমির মালিক নন, তারাও অংশ নেন অন্যের জমিতে মজুরি করতে। প্রতিবেশীর প্রয়োজনে সাড়া দিতে কেবল পারিশ্রমিকই যথেষ্ট, এটাই গ্রামীণ বাংলাদেশের ঐতিহ্য।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে বাড়ির চিত্র আরেক রকম। নারী সদস্যরা কুলা, ডালি হাতে ধান বাছাই-মাড়াইয়ে ব্যস্ত। দক্ষিণ দুয়ারি ঘরে প্রাকৃতিক বাতাসে কুলা দিয়ে ধান উড়িয়ে আগাছা পরিষ্কারের দৃশ্য যেন এক জীবন্ত শিল্পকর্ম।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
গল্পের নায়ক গফুর মিয়া একজন বর্গাচাষি। পাশের গ্রামের স্কুলশিক্ষকের ২.৫ বিঘা জমিতে এবার চাষ করেছেন। ভাগ হিসেবে পেয়েছেন অর্ধেক ফলন। ভালো ফলন হওয়ায় ওই ভাগ দিয়েই ছয় মাসের জীবিকা নির্বাহ সম্ভব। এক সময় তার বাপ-দাদার জমি ছিল। এখন তা নদীগর্ভে। তবুও তার চোখে নেই আক্ষেপ। নিজের জমির ধান কাটার পর তিনি এখন মজুরির বিনিময়ে অন্যের জমির ধান কাটছেন। কথা বলতে বলতে তার মুচকি হাসি যেন বলে দেয়, এই সামান্য জীবনে তিনি তৃপ্ত, তিনি পরিপূর্ণ।
কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চলে সময়টিকে বলা হয় ‘কাটামারি’। কাটামারিকে ঘিরে তৈরি হয় উৎসব ‘হালখাতা’। কৃষকেরা হালচাষ থেকে শুরু করে তেল, সারসহ প্রয়োজনীয় জিনিস স্থানীয় দোকান থেকে বাকিতে সংগ্রহ করেন। কাটামারির পর ফসল বিক্রি করে হালখাতার দিনে দোকানদারদের পাওনা মিটিয়ে দেন। মিষ্টি মুখ আর কৃতজ্ঞতার অভিব্যক্তি নিয়ে সমাপ্ত হয় এ অর্থনৈতিক চক্র। এটি কেবল হিসাব মেটানোর সময় নয়; গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক জীবনের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
বিজ্ঞাপন
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, যিনি আমাদের মুখে ভাত তুলে দেন, যার হাতে সোনার ফসল ফলে, তার প্রকৃত মর্যাদা কি সমাজ দেয়? মাটি ও মানুষের এই অমূল্য কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে আছে আত্মত্যাগ, জড়িয়ে আছে সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু রাষ্ট্রের খাতায় সেই নামগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়।
এ অবহেলা দূর করা এখন সময়ের দাবি। কৃষকের প্রতি সম্মান, প্রণোদনা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই একটি শক্তিশালী ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভরকেন্দ্রেই যিনি দাঁড়িয়ে আছেন; তার হাতে গড়া সোনার ফসলে আজও পাওয়া যায় মাটির ঘ্রাণ, পাওয়া যায় জীবনের সত্যিকার স্বাদ।
বিজ্ঞাপন
লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।
এসইউ/এমএস
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন