টেকসই কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় জীববৈচিত্র্য

কৃষিতে জীববৈচিত্র্য বলতে বোঝায় কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত জীবের বৈচিত্র্য, যেমন—ফসল, গাছপালা, গবাদিপশু, মাছ, কীটপতঙ্গ, মাইক্রোঅর্গানিজম (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক) ইত্যাদির বৈচিত্র্য। এর অর্থ, কৃষিকাজে ব্যবহৃত বা কৃষি পরিবেশে বসবাসকারী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতি এবং তাদের বিভিন্ন জাত বা বৈচিত্র্য।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মূল উপাদান
বহু জাত ও প্রজাতির চাষ: একই জমিতে বিভিন্ন জাত ও প্রজাতির ধান, গম, ভুট্টা, সবজি, ফল ইত্যাদির ফসল চাষ করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা যায়।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় জাতের সংরক্ষণ: স্থানীয় এবং প্রাচীন জাতের ফসল ও গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি প্রভৃতি বিভিন্ন গবাদিপশু সংরক্ষণ জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।
জৈব চাষ: রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদ কৃষিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
আন্তঃফসল চাষ ও ফসল ঘূর্ণন: মাটির গুণমান ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর এই কৌশল দুটি।
আবাসস্থল সংরক্ষণ: কৃষিজমির পাশে থাকা বনাঞ্চল, জলাশয়, প্রাকৃতিক ঘাসভূমি ইত্যাদি সংরক্ষণ জীববৈচিত্র্য বজায় রাখে।
বিজ্ঞাপন
পরাগায়নকারী ও উপকারী পোকামাকড় সংরক্ষণ: মৌমাছি, প্রজাপতি, জৈব কীটনাশক হিসেবে কাজ করে এমন পোকা সংরক্ষণ প্রয়োজন।
মাটি ও উদ্ভিদের উপকারী মাইক্রোঅর্গানিজম: ব্যাকটেরিয়া, রাইজোবিয়াম, ছত্রাক ইত্যাদি।
জিনগত সম্পদের সংরক্ষণ: বীজ ব্যাংক, কৃষক-পরিচালিত বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তোলা।
বিজ্ঞাপন
টেকসই কৃষিপদ্ধতি: পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি না করে কৃষিকাজ পরিচালনা।
স্থানীয় জ্ঞান ও চর্চার সংরক্ষণ: কৃষক সমাজের অভিজ্ঞতা, চিরাচরিত পদ্ধতি ও কৌশল সংরক্ষণ করা।
সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার: কৃষকদের জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া।
বিজ্ঞাপন
জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কাজ শুরু
আধুনিক অর্থে জীববৈচিত্র্য নিয়ে পরিকল্পিত কাজ শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে। বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি হলেন:
বাংলাদেশ বন বিভাগ: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই বন বিভাগ দেশের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল (যেমন- সুন্দরবন, লাউয়াছড়া, রেমা-কালেঙ্গা) রক্ষার কাজ করে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বন বিভাগ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ: এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ বিশেষ করে ফিশারিজ, ভেটেরিনারি ও এগ্রিকালচারাল বায়োলজির শিক্ষক ও গবেষকরা জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা শুরু করে স্বাধীনতার পর থেকে। প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম, প্রফেসর মো. আনোয়ারুল ইসলামসহ অনেকে জীববৈচিত্র্য বিষয়ে গবেষণা ও জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখেন।
আইইউসিএন বাংলাদেশ: আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
বিজ্ঞাপন
বেসরকারি সংস্থা ও পরিবেশবাদী আন্দোলন: পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এবং ওয়াইল্ড টিম (সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে)–এসব সংগঠন জীববৈচিত্র্য বিষয়টিকে জনপরিসরে নিয়ে আসে।
জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা: বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য একটি জাতীয় কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এটি জাতিসংঘের সিবিডির (কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি) অংশ হিসেবে তৈরি।
অন্যান্য: জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন- ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে। রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং নানা এনজিও কৃষিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
দাতা সংস্থার নেতৃত্ব
কৃষিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়ে অনেক দাতা সংস্থা কাজ করে থাকে। তবে উদ্যোগটি শুরু করেছে মূলত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বায়োভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল। এরা বিশ্বজুড়ে কৃষিভিত্তিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তবে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাতা ও অংশীদার সংস্থার নাম নিচে দেওয়া হলো:
এফএও: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কৃষিভিত্তিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই কৃষিচর্চায় সহায়তা করে আসছে বহুদিন ধরে।
বায়োভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল: বর্তমানে এটি কৃষিভিত্তিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য একটি প্রধান প্রতিষ্ঠান।
জিইএফ: গ্লোব্যাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্পে অর্থায়ন করে, যার মধ্যে কৃষিজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণও একটি।
আইএফএডি: ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস ও কৃষিতে টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজ করে।
সিজিআইএআর: একটি বৈশ্বিক গবেষণা অংশীদারত্ব, যা কৃষি উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গবেষণা করে।
বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কাজ মূলত সরকার, দাতা সংস্থা, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, গবেষক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগে শুরু হয়। এর মূল চালিকাশক্তি ছিলেন প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি দায়িত্বশীল গবেষক ও প্রশাসনিক নেতৃবৃন্দ। কৃষিকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই করার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষিতে জীববৈচিত্র্য হলো কৃষিজ পরিবেশে জীবজগতের বিভিন্নতা, যা টেকসই কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এসইউ/এমএস
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন