গবাদিপশুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
বাংলাদেশে গবাদিপশুর ভাইরাসজনিত রোগগুলোর মধ্যে ক্ষুরা রোগ অন্যতম। এটি পশুর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হ্রাস করে, বিশেষ করে দুধ উৎপাদনকারী পশুর ক্ষেত্রে পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে দেয়। ফলে কৃষক ও খামারিরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। তাই ক্ষুরা রোগ তাদের জন্য আতঙ্কের নাম। যদিও সব ঋতুতেই এ রোগ দেখা যেতে পারে। তবে বর্ষাকালে এর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে বেশি হয়ে থাকে। সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে এ রোগের সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
তাই এ রোগের লক্ষণ, বিস্তার, প্রতিরোধ এবং করণীয় সম্পর্কে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. গোলজার হোসেন। লিখেছেন মোহাম্মদ সোহেল রানা—
ক্ষুরা রোগ কী
ক্ষুরা রোগ (হ্যান্ড ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ বা এফএমডি) গবাদিপশুর একটি মারাত্মক, অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ। রোগটি মূলত গরু, শুকর, ভেড়া, ছাগল এবং অন্যান্য দ্বিখুরবিশিষ্ট প্রাণীদের হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বে রোগটির কারণে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। এটি একটি ছোট আকারের, নন-এনভেলপড ভাইরাস, যার জিনোম পজিটিভ-সেন্স, সিঙ্গেল স্ট্রান্ডেড আরএনএ দিয়ে গঠিত। এটি পিকোর্নাভিরিডি পরিবারভুক্ত এবং অ্যাফথোভাইরাসগণের অন্তর্ভুক্ত।
এ ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য হলো—এটি দ্বিখুরবিশিষ্ট (খুরযুক্ত) প্রাণীদের সংক্রমিত করতে সক্ষম। ক্ষুরা রোগের ভাইরাসের সাতটি স্বতন্ত্র সিরোটাইপ আছে, যেগুলো হলো: ও, এ, সি, স্যাট ১, স্যাট ২, স্যাট ৩ এবং এশিয়া ১। কিন্তু বাংলাদেশ সিরোটাইপ এ, ও এবং এশিয়া ১-এর প্রাদুর্ভাব আছে।
কোন মৌসুমে বা পরিবেশে বেশি দেখা যায়
ক্ষুরা রোগের ভাইরাসটি পরিবেশে দীর্ঘসময় পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে সক্ষম এবং বছরজুড়েই দেখা যায়। তবে সাধারণত এ রোগ বর্ষা মৌসুমে এবং শীতের শুরু ও শেষের দিকে তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্ষার পরবর্তী মৌসুমে এটি বেশি হয়েছে। এটি মূলত আর্দ্রতা বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা ও প্রাণীর আচরণে পরিবর্তনসহ একাধিক কারণে ঘটে থাকে।
ক্ষুরা রোগের লক্ষণসমূহ
● শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ৪০° সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় (জ্বর)।
● শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যেমন জিহ্বা, তালু, ঠোঁট ও মাড়ি, নাকের ডগা, ক্ষুরের গোড়া, ক্ষুরের মাঝখানের ফাঁক, দুধ দেওয়া গরুর স্তনের বোঁটাতে ফোসকা তৈরি হয়।
● তীব্রভাবে আক্রান্ত গরুতে অতিরিক্ত লালা ঝরা, পা দিয়ে মাটি ঠোকাতে দেখা যায়। দুগ্ধজাত প্রাণীর ক্ষেত্রে দুধ কমে যায়।
ক্ষুরা রোগ কীভাবে ছড়ায়
● আক্রান্ত প্রাণীর সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে যোগাযোগের মাধ্যমে।
● পরোক্ষ সংস্পর্শে আক্রান্ত প্রাণীর নিঃসরণ ও বিসর্জনের মাধ্যমে (যেমন: বীর্য, দুধ)।
● বাহকদ্বারা যেমন- মানুষ, ঘোড়া, কুকুর, বিড়াল, পাখি, গাড়ি ইত্যাদি।
● বাতাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
● শ্বাস-প্রশ্বাস, খাবারের মাধ্যমে এবং ত্বকের ক্ষত বা শ্লেষ্মা ঝিল্লির মাধ্যমে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
সময়মতো কার্যকর টিকা দেওয়া এবং বায়োসিকিউরিটি মেনে ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধ করা যায়। ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত পশুদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ওষুধ নেই। তবে এ রোগে আক্রান্ত প্রাণীর ক্ষত অংশে যাতে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রামণ না ঘটে; সেজন্য কিছু সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া হয়। মুখ, জিহ্বা, পা, খুর, টিটের ওপর পাওয়া ক্ষতযুক্ত ফোস্কাগুলো সাধারণ স্যালাইন, অ্যাসিড সাইট্রিক ১% বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ১%, অ্যালাম ২%, নীল মিথিলিন ১%, জাতীয় দ্রবণগুলো মধ্যে একটি দিয়ে পানির সঙ্গে পরিমাণমতো মিশিয়ে তা দিয়ে ধুয়ে ফেলা।
সুস্থ পশুকে রক্ষা করতে করণীয়
● আক্রান্ত পশুকে দ্রুতই অন্যান্য সুস্থ পশু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে, যাতে রোগ ছড়ানো বন্ধ হয়।
● খামার থেকে অন্য স্থানে পশু চলাচল বন্ধ রাখতে হবে এবং বাইরের পশু খামারে আনা নিষিদ্ধ করতে হবে।
● খামারের আশপাশ এবং পশু থাকার জায়গা নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
● বিশেষ করে আক্রান্ত পশু স্পর্শ করার পর হাত ও পোশাক ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করতে হবে।
● ঝুঁকিপূর্ণ সব সুস্থ পশুকে দ্রুত টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
● কৃষক, খামারি ও শ্রমিকদের ক্ষুরা রোগের লক্ষণ, সংক্রমণ পথ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানানো এবং সচেতন করা।
যেসব ভুলের কারণে বাড়তে পারে রোগ
● ক্ষুরা রোগের টিকাদানে অনীহা বা অনিয়ম।
● আক্রান্ত পশুকে দ্রুত আলাদা না করা।
● খামার এবং পশু থাকার স্থান জীবাণুমুক্ত না রাখা।
● হাত-মুখ ধোয়া ও পোশাক পরিবর্তন না করা।
এসইউ/এএসএম