ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ক্যাম্পাস

ভয় নয়, অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের মূল শক্তি সচেতনতা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক | বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | প্রকাশিত: ১১:২৮ এএম, ০১ নভেম্বর ২০২৫

দুই মাস ধরে দেশের কয়েকটি জেলায় অ্যানথ্রাক্স নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে এটি ভয় পাওয়ার বিষয় নয়, বরং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা বাড়ানোর সময় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাহবুব আলম।

তিনি বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্সকে বায়োটেররিজমের মতো আতঙ্কের কিছু মনে করার কারণ নেই। ২০১০ সালে সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় যেভাবে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়েছিল, সেটি ছিল নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটি পরিস্থিতি। সম্প্রতি রংপুর, গাইবান্ধা ও মেহেরপুরে গবাদিপশু থেকে মানুষের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হচ্ছে। কিন্তু এখনো এটি আতঙ্কজনক পর্যায়ে নয়।’

তিনি জানান, ‘অ্যানথ্রাক্স হচ্ছে Bacillus anthracis ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি প্রাচীন ও তীব্র প্রকৃতির রোগ, যা মানুষ ও পশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। ১৮৭৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কখ এই ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করেন। বাংলাদেশে প্রথম অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয় ১৯৪৯ সালে।’

অধ্যাপক মাহবুব বলেন, ‘করোনার মতো অ্যানথ্রাক্স মহামারি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এই জীবাণুর ৮৯টি স্ট্রেইনের অ্যান্টিজেনিক পার্থক্য না থাকায় একে অতিমারি বলা যায় না। এর ভিরুলেন্ট বা রোগসৃষ্টিকারী কিছু স্ট্রেইন আছে, আবার নন-ভিরুলেন্ট স্ট্রেইন দিয়েই ভ্যাকসিন তৈরি হয়— যেমন বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত Sterne strain।’

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক জীবাণুর প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়ায় যদি কোনো মিউটেশন ঘটে, তাহলে সেটি নতুন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই ধারাবাহিক গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।’

অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে এটি স্পোর তৈরি করে, যা পরিবেশে অত্যন্ত প্রতিরোধী।

অধ্যাপক মাহবুব বলেন, ‘এই স্পোর সাধারণ জীবাণুনাশকেও টিকে থাকতে পারে এবং মৃত পশুর চামড়ায় বহু বছর কর্মক্ষম থাকে। এজন্য মৃত গরুর চামড়া বা দেহ উন্মুক্ত স্থানে ফেলা বিপজ্জনক। একবার স্পোর মাটিতে গেলে তা ৬০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।’

বৃষ্টির পর নতুন ঘাস গজালে গরু সেই ঘাসের সঙ্গে স্পোর খেয়ে সংক্রমিত হয়। এরপর এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে, আবার মানুষেও রোগটি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত পশুর রক্ত, মাংস কিংবা মৃতদেহের সংস্পর্শে এলে মানুষও ঝুঁকিতে পড়ে।

অনেক সময় গরিব খামারি আক্রান্ত পশু বিক্রি করে দেন অর্ধেক দামে, আর অজ্ঞ কসাই সেটি জবাই করে বাজারে বিক্রি করেন। এখান থেকেই সংক্রমণ ছড়ায় বলে জানান অধ্যাপক মাহবুব।

তিনি যোগ করেন, মৃত পশু উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখলে শিয়াল, কাক বা কুকুর সেগুলো খেয়ে বা টেনে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে স্পোর ছড়িয়ে দেয়। এমনকি রক্তচোষা মাছি বা অন্যান্য পোকামাকড়ও রোগটি ছড়াতে পারে।

এই ব্যাকটেরিয়া ক্ষার বা অ্যালকালাইন মাটিতে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে, অথচ অম্লীয় মাটিতে টিকে থাকতে পারে না। অধ্যাপক মাহবুব বলেন, ‘পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী অঞ্চল যেমন মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী ও রাজশাহীর মাটি ক্ষারীয়। এসব এলাকা অ্যানথ্রাক্স বেল্ট হিসেবে পরিচিত।’

আরও পড়ুন-
গাইবান্ধায় ৮০ পয়সার অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাকসিনের দাম ২০ টাকা
সুন্দরগঞ্জে অ্যানথ্রাক্সের টিকা পেয়েছে মাত্র ৮ ভাগ গবাদিপশু
গবাদিপশুর অ্যানথ্রাক্স যখন মানবদেহে, করণীয় কী?

তার মতে, ‘দেশে টিকার ঘাটতি থাকায় এসব ক্ষারীয় অঞ্চলের পশুকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দিতে হবে। ভ্যাকসিন প্রয়োগের ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে প্রাণীর দেহে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তাই দুই সপ্তাহ পর মাংস খাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।’

প্রাণীতে এই রোগ পার-অ্যাকিউট, অ্যাকিউট, সাব-অ্যাকিউট ও ক্রনিক—এই চার রূপে দেখা যায়। দ্রুত মৃত্যু, রক্তক্ষরণ ও গলার নিচে ফোলাভাব এর সাধারণ লক্ষণ।

মানুষের ক্ষেত্রে ত্বক, ফুসফুস ও অন্ত্র— এই তিনভাবে সংক্রমণ হয়। ত্বকে হলে ‘বিষফোঁড়া’, ফুসফুসে হলে ‘উল সর্টার রোগ’ নামে পরিচিত। রান্না না হওয়া মাংস খেলে অন্ত্রেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসায় এসব রূপই নিরাময়যোগ্য- বলেন তিনি।

অধ্যাপক মাহবুব বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্স মোকাবিলায় আতঙ্ক নয়, দায়িত্ববোধই প্রধান। অসুস্থ বা মৃত প্রাণী কখনো জবাই করা যাবে না। বায়ুর সংস্পর্শে এলে জীবাণু স্পোর তৈরি করে। তাই মৃত পশুকে অন্তত ৬–৭ ফুট গভীরে চুন দিয়ে পুঁতে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিও একইভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘টিভি, রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত ভেটেরিনারিয়ান ও মাঠকর্মী নিয়োগ দেওয়া জরুরি। গবাদিপশু জবাইয়ের আগে দক্ষ ভেটেরিনারির তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।’

অধ্যাপক মাহবুব আরও বলেন, ‘প্রতিটি জেলা ও সিটি করপোরেশনে আধুনিক কসাইখানা স্থাপন করতে হবে, যাতে সুরক্ষিত মাংস সরবরাহ নিশ্চিত হয়। প্রয়োজনে ‘Animal Slaughter Act’ ও ‘Quarantine Act’ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’

ভেটেরিনারিয়ান, কসাই, মাংস ব্যবসায়ী বা যারা নিয়মিত পশুর সংস্পর্শে থাকেন, তাদের টিকা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মৃত পশুর মালিকদের জন্য ইনস্যুরেন্স ও ভর্তুকি চালু করতে হবে। একইসঙ্গে অ্যানথ্রাক্সসহ অন্যান্য ইমার্জিং রোগ নিয়ে গবেষণার জন্য আলাদা গবেষণা তহবিল গঠন জরুরি।

সবশেষে তিনি জানান, ‘অ্যানথ্রাক্সের ভয় নয়, আমাদের প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ, গবেষণায় ধারাবাহিকতা ও সবার দায়িত্ববোধ। তাহলেই এই পুরোনো রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।’

এফএ/এমএস