অর্থসংকটে স্থবির ইবির নির্মাণাধীন হল, সাইট ছাড়লেন শতাধিক শ্রমিক
নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক জটিলতার কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) নির্মাণাধীন দুটি ১০ তলা আবাসিক হলের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কর্মীদের বকেয়া বেতন-ভাতা ও খোরাকি পরিশোধ করতে না পারায় ইট-গাঁথুনি এবং টাইলসের কাজে যুক্ত শতাধিক শ্রমিক সাইট ছেড়ে চলে গেছেন। এর ফলে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সময়সীমা আরও বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নির্মাণস্থলে শ্রমিকের উপস্থিতি কম। ইট-গাঁথুনি ও টাইলসের কাজ পুরোপুরি বন্ধ। স্বল্প শ্রমিক থাকায় একটি ভবনের কাজ বন্ধ করে অন্যটির কাজ করা হচ্ছে। তবে লোকবল কমলেও রেলিং, প্লাস্টার ও সিলিং প্লাস্টারের কাজ চলমান। সাইটের পরিবেশে স্থবিরতা, অসমাপ্ত দেয়াল ও পড়ে থাকা নির্মাণসামগ্রীর মধ্যেই শ্রমিকরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতি থাকলেও পূর্ণ গতিতে কাজ ফেরার কোনো দৃশ্যমান প্রস্তুতি চোখে পড়েনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এমআরটি কনস্ট্রাকশনের মালিকের আর্থিক সংকটের কারণে এই জটিলতা তৈরি হয়েছে। শ্রমিকদের কয়েক মাস বেতন ও খোরাকি বকেয়া থাকায় ইট-গাঁথুনি ও টাইলসের কাজ প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক টাইলস মিস্ত্রি ছাড়া শতাধিক শ্রমিক সাইট ছেড়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী সিএফটি (Cubic Feet) ও আরএফটি (Running Feet) হারে পেমেন্ট কম হওয়ায় সুপারভাইজারদের লোকসানের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক দেশের বাইরে থাকায় অর্থ ছাড় ও শ্রমিক ফেরানো অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ভবনের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৮ শতাংশ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। প্রশাসন পূর্বনির্ধারিত চুক্তি অনুযায়ী অর্থ প্রদান করলেও নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় অর্থ ছাড় ও শ্রমিক ফেরানো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাজ বন্ধের কোনো বাধা নেই এবং বিল প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা চলমান।
সাইট ইঞ্জিনিয়ার মেশকাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সরবরাহকারীদের কিছু পাওনা বাকি থাকার কারণে ইট গাঁথুনির কাজ বন্ধ আছে। এদিকে বেতন ও খোরাকি না পাওয়ায় টাইলসের তিনজন মিস্ত্রি ব্যতীত বাকি প্রায় ১০০ জন মিস্ত্রি-শ্রমিক সাইট ছেড়ে চলে গেছেন। তিন মাস পর তারা একবার বেতন পেলেও তাদেরকে খোরাকি বা খাবারের বিল পর্যন্ত দেওয়া যায়নি।
মিস্ত্রি-শ্রমিকদের সাইট ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাব-কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে মিস্ত্রি ও লেবারদের চুক্তিতে সমস্যা হচ্ছে। চুক্তির টাকা সিএফটি (Cubic Feet) বা আরএফটি (Running Feet) হিসেবে করা। কিন্তু লেবার খরচ বেশি হওয়ায় সাব-কন্ট্রাক্টরদের লস হচ্ছে। তাই পর্যাপ্ত টাকা না পাওয়ায় লোকবল কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। টাইলস মিস্ত্রিদের পারিশ্রমিক নিয়েও বিতর্ক আছে। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান প্রতি জোড়ার জন্য ১২০০ টাকা দেয়, কিন্তু মিস্ত্রিরা ১২৫০ টাকা দাবি করছে।” এসময় নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক দেশে আসলে বিষয়টা সমাধান হবে বলে তিনি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসন থেকে কাজ বন্ধের কোনো নির্দেশনা নেই। ট্রেজারার, পিডি (প্ল্যানিং ডিরেক্টর), ইঞ্জিনিয়ারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়মিত সাইট ভিজিট করছেন এবং বিল করার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। নির্মাণাধীন কাজের বিল প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এছাড়া এস্টিমেট তৈরির পর তা ইঞ্জিনিয়ার অফিস, শিক্ষামন্ত্রী এবং ভিজিট টিমের কাছে যাবে। মেজারমেন্ট বুকে হাতে লেখা ও ট্রেজারার রুম পার হয়ে বিল ছাড়পত্র পেতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় লেগে যায়।

সাব-কন্ট্রাক্টর (রাজমিস্ত্রি প্রধান) আমিনুল ইসলাম বলেন, ইট ও রডের দায়িত্বসহ রাজের সার্বিক দায়িত্বে আমি আছি। কোম্পানির আর্থিক সমস্যার কারণে পাথরসহ অন্যান্য মালামাল আসছে না। ফলে শ্রমিকও রাখা যাচ্ছে না। এছাড়া বর্তমান ইটভাটার ইটগুলো পুরাতন, নতুন ইট আসলে আমরা সেটা দিয়ে কাজ চালাবো।
টাইলসের সাব-কন্ট্রাক্টরের যোগাযোগ নম্বর চাইলে নম্বর নেই বলে জানান সাইট ইঞ্জিনিয়ার।
এ বিষয়ে হল দুটির তত্ত্বাবধায়ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। প্রতিদিনই আমি পরিদর্শনে যাই। তারা বিল জমা দিলেই প্রশাসন পূর্বনির্ধারিত চুক্তি অনুযায়ী টাকা প্রদান করবে। এ নিয়ে উপাচার্য এবং প্ল্যানিং ডিরেক্টরের সাথে মিটিং হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কিছুটা সংকটে পড়েছে।
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রকৌশলী (সিভিল) মো. আলীমুজ্জামান টুটুল বলেন, ভবনের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৮ শতাংশ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। আর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রায় এক মাস আগেও ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। তিনি প্রায়ই দেশের বাইরে যান।
চলতি মাসের শেষ দিকে কাজ শুরু হবে উল্লেখ করে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটির জিএম তোজাম্মেল হোসেন বলেন, কোম্পানির কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয়ের কারণে কাজ আটকে আছে। বিশেষ করে আর্থিক কিছু সংকটের কারণে মাল আসছে না। এই মাসের শেষের দিক থেকে পুরোদমে কাজ চলবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, নির্মাণাধীন হল দুটি পরিদর্শন গেলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, দুই-এক দিনের মধ্যে কাজ শুরু করবে। আমি বলেছি, নির্দিষ্ট টাইম আমাদেরকে বলতে হবে। পরবর্তীতে আমি চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠাই। চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওদের সঙ্গে মিটিং করে আমাকে জানায় যে ওদের আর্থিক সংকট সমাধান করে শীঘ্রই কাজ শুরু করবে।
ইরফান উল্লাহ/কেএইচকে/জেআইএম