চবিতে প্রথম হওয়ার গল্প শোনালেন তাসমিন
‘কলেজে পড়ার সময় ক্লাসে একদিন কলি ম্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। বলেন, আমাদের কলেজের মেয়েরা প্রায়ই চবিতে চান্স পায়। কয়েক বছর আগে একজন প্রথম হয়। সে কলেজের সুনাম যেমন বৃদ্ধি করেছে, উজ্জ্বল করেছে বাবা-মায়ের মুখ। চেষ্টা আর আগ্রহ থাকলে তোমরাও পারবে। ম্যামের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। সেই থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু। এরপর পার হয়ে যায় লম্বা সময়। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ছিল অদম্য পরিশ্রম।’
সোমবার (২২ মে) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অনুষদের ফল প্রকাশ হলে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ক্লাসে বসে দেখা স্বপ্ন কী তাহলে সত্যি হলো? বলছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদভুক্ত ‘এ’ ইউনিটে প্রথম হওয়া তাসমিন আক্তারের গল্প। গতকাল প্রকাশিত ফলাফলে ২৬ হাজার ৯০৮ জন উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়েছেন তিনি। তার প্রাপ্ত নম্বর ১০৬.২৮।
জাগো নিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন ভর্তি যুদ্ধের গল্প।
শিক্ষক বাবা এবং গৃহিণী মায়ের মেজো মেয়ে তাসমিন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী। জেএসসি পরীক্ষায় রায়ছটা প্রেমাশিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ ও বৃত্তি পান তিনি। মাঝে এসএসসিতে জিপিএ-৫ মিস গেলেও দমে যাননি। কাপাশগোলা সিটি করপোরেশন মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়ে মেধার সাক্ষর রাখেন। এরপর শুরু হয় ভর্তির জন্য প্রস্তুতি।
তাসমিন বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা করে পড়াশোনা করতাম। সকালের প্রার্থনা শেষেই শুরু হতো পড়াশোনা; যা চলতো রাত পর্যন্ত। কখনো এমন হতো পড়া শেষ হয়নি, কিন্তু ঘুম চলে এসেছে। তখন কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আবার রাতে উঠে পড়তে বসতাম।
তিনি বলেন, ভর্তির প্রস্তুতি নিতে গিয়ে হতাশ হয় অনেক শিক্ষার্থী। আমারও ব্যতিক্রম নয়। মাঝে মধ্যে কোচিংয়ের পরীক্ষায় আশানুরূপ নম্বর পেতাম না। এত পরিশ্রমের পরও নম্বর কম দেখলে কষ্ট লাগতো। কিন্তু হতাশ হইনি। সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস ছিল, লেগে থাকলে তিনি নিরাশ করবেন না। তাই পরিশ্রম আরও বাড়িয়েছি, হাল ছেড়ে দিইনি।
তাসমিনের সফলতার পেছনে অন্যতম অবদান বাবা-মায়ের। তার ভাষ্য, ‘ছোটবেলা থেকেই বাবার সংগ্রাম দেখে বড় হয়েছি। বাবার আর্থিক অবস্থা এত বেশি ভালো ছিল না। তবে আমাদের পড়াশোনায় ঘাটতি রাখতেন না। নিজে সারাদিন পরিশ্রম করলেও খোঁজ রাখতেন পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছি কি না। কিন্তু কখনোই পড়ার জন্য জোর করতেন না। বুঝিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করতেন। মা লেগে থাকতেন ছায়ার মতো। আমার যেকোনো পরীক্ষার আগে থেকেই তাহাজ্জুদে সময় কাটাতেন আর চোখের পানি ফেলতেন। তাদের এত ইচ্ছা ও চেষ্টা আমাকে দ্বিগুণ অনুপ্রাণিত করতো।’

তাসমিনের সফলতার পেছনে আছে বন্ধুদেরও অবদান। তিনি বলেন, কলেজ থেকেই আমরা চার বান্ধবী প্রতিযোগিতা করে পড়তাম। কে কার থেকে ভালো নম্বর পাবে তা নিয়ে লড়াই হতো। এর মধ্যে দিব্য চক্রবর্তীর সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ চলতো। একজন অন্যজনকে পড়াশোনায় সাহায্য করতাম। ভর্তির সময়ও তাদের ভূমিকা ছিল মুখ্য।’
অনেকেই অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সময় নষ্ট করে দাবি করে তাসমিন বলেন, আমি খুব কম মোবাইল ফোন ব্যবহার করতাম। মাঝে মধ্যে ফেসবুকে ঢুকতাম বিভিন্ন তথ্য জানার জন্য। পরে দেখি এতেও সময় নষ্ট হচ্ছে। তাই ডেন্টাল পরীক্ষার পর আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিই।
চবিতে কী নিয়ে পড়বেন সে সিদ্ধান্ত এখনো সিদ্ধান্ত নেননি তাসমিন। তার ইচ্ছা ফার্মাসি অথবা সিএসই। তবে যে সাবজেক্টেই ভর্তি হোন না কেন ধরে রাখতে চান পড়ার আগ্রহ। ভালো রেজাল্ট করে হতে চান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ দিতে গিয়ে হেসে ওঠেন তাসমিয়া। বলেন, সব সময় পরামর্শ শুনে এসেছি। এখন অন্যকে পরামর্শ দেবো ভাবতেই নার্ভাস লাগছে। তবে আমার মনে হয় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর উচিত নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া। বুঝতে শেখা সে নিজে কী চায়। তারপর লক্ষ্য স্থির করে পরিশ্রমে নেমে পড়া। ব্যর্থতা আসলে দ্বিগুণ উৎসাহে পরিশ্রম বাড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে রাখতে হবে গভীর সম্পর্ক।
তাসমিয়ার সফলতায় আনন্দের জোয়ার বইছে বাবা-মায়ের চোখে। অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা মোছা. বেবী আক্তার বলেন, ‘আমি প্রতি রাতে আল্লাহর কাছে চাইতাম তিনি যেন আমার মেয়ের পরিশ্রমকে কবুল করেন। আমার মেয়েকে সম্মানিত করেন। আজ যখন রেজাল্ট পাই রবের কাছে শুকরিয়া প্রকাশের উপায় পাচ্ছিলাম না। আমি খুবই আনন্দিত।’
শিক্ষক বাবা মোহাম্মদ মনছুরুল আলম বলেন, বাবা-মায়ের কাছে সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ সন্তানের সফলতা। মেয়ের পরিশ্রম চোখের সামনে দেখেছি। তখন ভাবতাম এত চেষ্টা যেহেতু করছে ভালো কিছুই হবে। কিন্তু আমার মেয়ে এত ভালো করবে কল্পনায়ও ছিল না। রেজাল্টের পর থেকেই সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে, কল দিচ্ছে। গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের আনন্দে খুশি তাসমিনও।
এফএ/এএসএম