মানসিক প্রতিবন্ধী স্ত্রীর জন্য মানিক শিকদারের বিরল ভালোবাসা

সাত বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন স্ত্রী। সংসারের কোনো কাজই করেন না। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান। তারপরও স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করেননি মাদারীপুরের মানিক সিকদার (৭০)। ভালোবেসে আগলে রেখেছেন স্ত্রীকে। নিয়ম করে তিনবেলা নিজ হাতে খাইয়ে দেন। জানালেন ভালোবেসে এভাবেই বাকি জীবন কাটাতে চান মানিক শিকদার।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর শহরের পুরানবাজারের কাজীর মোড় এলাকার মৃত জব্বার শিকদারের ছেলে মানিক শিকদার। ৪০ বছর আগে বিয়ে করেন ফরিদপুরের নগরকান্দার রাজা মজুমদারের মেয়ে সুফিয়া বেগমকে (৫৫)। বিয়ের পর তাদের পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়। বড় ছেলে সবুজ শিকদার (৩৫) কিছুই করেন না। তিনি অসুস্থ, মানসিক প্রতিবন্ধী। মেজ ছেলে মিলন শিকদার (৩২) দুই বছর আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান। ছোট ছেলে সুজন শিকদার (২৮) খাবারের হোটেলে কাজ করেন। বিয়ে দিয়েছেন দুই মেয়ে মুন্নি ও পান্নার। তারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
দুই ছেলে থাকেন আলাদা। তাই এই বৃদ্ধ বয়সে মানিক শিকদার পুরানবাজারে পান ও সিগারেট বিক্রি করেন। এতে যা আয় হয় তা দিয়েই কোনোভাবে চলে যাচ্ছে দুজনের সংসার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় সাত বছর আগে হঠাৎ মানসিক সমস্যা দেখা দেয় সুফিয়া বেগমের। এরপর থেকে সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করেন। রান্না করতে পারেন না। সংসারের কোনো কাজও করতে পারেন না তিনি। হোটেল থেকে খাবার এনে তিনবেলা নিজ হাতেই স্ত্রী সুফিয়া বেগমকে খাইয়ে দেন মানিক শিকদার।
মানিক শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওর সব খেয়াল আমাকেই রাখতে হয়। সারাদিন মনে হয় কোথায় যদি একা একা গিয়ে হারিয়ে যায়। তাই যতটুকু সম্ভব দেখে রাখি। সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করলেও রাতের বেলা আমার কাছে চলে আসে। একসঙ্গে ঘুমাই।’
তিনি বলেন, ‘স্ত্রীর এই অবস্থা। রান্না কে করে দেবে? আমিও রান্না করতে পারি না। তাই তিনবেলা হোটেল থেকে খাবার কিনে আনি। তারপর নিজ হাতেই ওকে খাইয়ে দেই। পাগল হলেও তো ও (সুফিয়া) আমার স্ত্রী। তাই ওর দিকে খেয়াল রাখি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই ওকে আগলে রাখতে চাই।’
কথা হয় মানিক শিকদারের প্রতিবেশী সোহাগ হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মানিক শিকদারের স্ত্রীর মানসিক সমস্যা আছে। সারাদিন রাস্তায় থাকেন। তবুও মানিক তার স্ত্রীকে ভালোবাসেন, যত্ন নেন। নিজ হাতেই খাইয়ে দেন। এমন ভালোবাসা আজকাল তেমন একটা চোখে পড়ে না।’
মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, ‘স্ত্রীর প্রতি মানিকের ভালোবাসা বিরল। কারণ বর্তমান যুগে নিজের স্বার্থই সবাই আগে বোঝে। সেখানে স্ত্রী পাগল হলেও মানিক খুব সুন্দরভাবে আগলে রেখেছেন।’
স্থানীয় সংগঠন জাগো উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ফারজানা আক্তার মুন্নি বলেন, ‘অনেক পরিবারে দেখেছি, কারও যদি মানসিক সমস্যা থাকে ধীরে ধীরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জীবন কাটান। সেখানে মানিক শিকদার ভালোবেসে তার স্ত্রীকে দেখাশোনা করছেন, এটা খুব কমই চোখে পড়ে।’
মাদারীপুর সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আফজাল হোসাইন বলেন, ব্যক্তিগতভাবে মানিককে ধন্যবাদ জানাই। কারণ তিনি নিজে বৃদ্ধ হয়েও মানসিক প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে ছেড়ে যাননি। এমন ভালোবাসা সমাজের উদাহরণ। তার স্ত্রী যদি প্রতিবন্ধী ভাতা না পান, তাহলে সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/এসআর/এমএস