যে ভাষা টিকে আছে দুই বোনের মুখে
দুই বোন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটার মুখে বাংলাদেশে টিকে আছে খাড়িয়া ভাষা
আদি একটি ভাষার নাম ‘খাড়িয়া’। তবে বাংলাদেশে এ ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র দুজন। তারা হলেন আপন দুই বোন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা। ভেরোনিকার বয়স ৮০ বছর। খ্রিস্টিনার ৭৫। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে ভাষাটি।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাসি, কোড়া, পাংখুয়া, খাড়িয়া, সৌরা, কোডা, মুন্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, রেংমিতচা, খিয়াং, পাত্র ও লুসাই ভাষাসহ ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে বাংলাদেশে। এসব ভাষাগুলো ব্যবহার করা লোকের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানের বর্মাছড়ায় ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা দুই বোন খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। তবে তাদের পরিবারের সদস্য ও খাড়িয়া সম্প্রদায়ের কোনো মানুষের ভাষাটির বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান নেই।

সম্প্রতি রাজঘাট চা বাগানে ঘুরে খাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকজন পাওয়া গেলেও ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা ছাড়া আর কোথাও প্রকৃত খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজার পর ভেরোনিকা কেরকেটার দেখা মেলে। এসময় তিনি খাড়িয়া ভাষা ও বাংলায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাবা-মা ভারতের রাচি থেকে এখানে আসেন। এখানে আমাদের জন্ম। বাবা-মা খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতেন। তাদের কাছ থেকেই এই ভাষা শিখেছি।’
‘অনেক ভাষার মিশ্রণের কারণে আমাদের সন্তানরা খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারে না। এমনকী বোঝেও না। এই বাগানের মধ্যে আমরা দুই বোন খাড়িয়াতে কথা বলতে পারি। পরিবারের অন্যরাসহ বাগানে কারও সঙ্গে আমরা প্রাণখুলে মনের মতো করে কথা বলতে পারি না। এটাই আমাদের দুঃখ’, আক্ষেপ করে বলেন ভেরোনিকা কেরকেটা।
খ্রিস্টিনা কেরকেটা বলেন, ‘আমরা দুই বোন একই বাগানের পাশাপাশি সেকশনের কলোনিতে সপরিবারে বসবাস করি। তাই যখন সময় পাই আমরা একসঙ্গে বসে আমাদের ভাষায় কথা বলি। আর কারও সঙ্গে খাড়িয়া ভাষায় খুব একটা আলাপচারিতা হয় না। এ কারণে খাড়িয়া ভাষাটি অনেকটা বিলুপ্তির মুখে। মাংরা বস্তির খাড়িয়া সম্প্রদায়ের জহরলাল ইন্দোয়ার সামান্য খাড়িয়া ভাষা বলতে পারে।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাড়িয়া জনগোষ্ঠী সাদ্রিবাংলা, দেশোয়ালী ও খাড়িয়া ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরনের ভাষায় কথা বলেন। খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ কিংবা বই-পুস্তক নেই। ভারতে এ ভাষার যথাযথ উপকরণ থাকলেও বাংলাদেশে কোনো বর্ণমালা নেই। খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম মিশ্রণ বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত।
খাড়িয়া ভাষার বিষয়ে আলাপকালে বর্মা ছড়ার খাড়িয়া সম্প্রদায়ের সন্তান শ্রীমঙ্গল দ্বারিকা পাল কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী লিজা ইন্দোয়ার ও শ্রীমঙ্গল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সীমা ইন্দোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মাতৃভাষা যে খাড়িয়া তা বাপ-দাদার কাছে শুনেছি, কিন্তু শিখতে পারিনি। বাংলায় লেখাপড়া করি আর বাবা-কাকারাও বাংলা, দেশোয়ালী ও ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরনের ভাষায় কথা বলেন। যে কারণে আমরা আমাদের মাতৃভাষা এখন বলতে পারি না। এমনকী বুঝিও না।’
ভেরোনিকা কেরকেটার বাড়িতে কথা হয় ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদের সঙ্গে। তিনি খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ‘প্রাণোজ্জ্বল একটি ভাষা’ উল্লেখ করে বলেন, ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটার মৃত্যু হয়ে গেলে হারিয়ে যাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা খাড়িয়া। এতে আমাদের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক সম্পদের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।’

রাজঘাট ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান সেলিম আহমদ জানান, রাজঘাট চা বাগানে খাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। ২০১৭ সালে বর্মাছড়া বাগানের উত্তরণ যুব সংঘের মাধ্যমে ‘বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার’ নামের একটি খাড়িয়া ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটার মাধ্যমে কিছু শিশুকে খাড়িয়া ভাষার বিষয়ে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হলেও সেটা সফলতার মুখ দেখেনি।
মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল হালিম বলেন, ‘যেহেতু দুই নারী ছাড়া দেশে আর কেউ ভাষাটি জানে না, বোঝে না বা চর্চা করে না; তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভাষা খাড়িয়া। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
এসআর/জিকেএস