পদ্মায় ভাঙন
‘কোনোমতে জানডা লইয়া বাহির হইছি, সব নদীতে তলাইয়া গেলো’
পদ্মার ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন রোকেয়া বেগম। ছবি-জাগো নিউজ
পদ্মার স্রোত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনপুরীতে রূপ নিচ্ছে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা এলাকা। এতদিন পদ্মা সেতু প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড রক্ষাবাঁধ ভাঙলেও এখন ভাঙন দেখা দিয়েছে ডান তীর রক্ষাবাঁধ প্রকল্প এলাকায়।
বুধবার (২৩ জুলাই) রাতে দুটি প্রকল্প এলাকার অন্তত আড়াইশ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এতে বসতবাড়ি হারিয়ে অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবে ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে পদ্মা সেতু থেকে মাঝিরঘাট হয়ে পূর্ব নাওডোবা আলমখার কান্দি জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকা। গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে বাঁধের নাওডোবা ইউনিয়নের মাঝিরঘাট এলাকার ধস শুরু হয়। ১৬ নভেম্বর বিকেল পর্যন্ত বাঁধটির প্রায় ১০০ মিটার ধসে পড়ে নদীতে। এতে কংক্রিটের সিসি ব্লকগুলো তলিয়ে যায় পানিতে।
এছাড়া এলাকাটির আশপাশে দেখা দেয় ফাটল। পরে বাঁধটির সংস্কারে দায়িত্ব দেওয়া হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। গত বছর ওই বাঁধের যে ১০০ মিটার অংশ বিলীন হয়েছিল, তা দুই কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই স্থানে বালুভর্তি জিওব্যাগ ও সিসিব্লক ফেলার কাজ শুরু করা হয়।
তবে ঈদের দিন থেকে এখন পর্যন্ত সাতবার বাঁধটি ভাঙনের কবলে পড়েছে। এতে কমপক্ষে ৫৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এছাড়া শতাধিক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট সরিয়ে নেন। পাশাপাশি ভাঙন ঠেকাতে এক লাখ জিওব্যাগ ডাম্পিং করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সূত্র জানায়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৮৬৯ কোটি টাকা ব্যায়ে প্রায় ৯ কিলোমিটার পদ্মা সেতু ডান তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এরইমধ্যে বাঁধের ৩৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় জাজিরার উকুল উদ্দিন মুন্সিকান্দি এলাকায় বুধবার ভোরের দিকে ভাঙন দেখা দেয়। এতে ওই এলাকার ১৫০ মিটার অংশ নদীতে চলে যায়।
তাৎক্ষণিকভাবে পাঁচটি পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আরও ১০টি পরিবার তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়। এ অবস্থায় উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কে দিন পার করছেন ওই এলাকার মানুষ।

জাজিরার উকুল উদ্দিন মুন্সিকান্দি এলাকার বাসিন্দা রোকেয়া বেগম। বুধবার রাতে স্বামী-সন্তান নিয়ে নিশ্চিত মনেই ঘুমাচ্ছিলেন নিজ বসতঘরে। হঠাৎ করেই ভাঙন দেখা দেয় তার বাড়ির পেছনে। কিছু না বোঝার আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় তার বসতঘর। কোনোমতে জীবন নিয়ে বের হতে পারলেও হারিয়েছেন মাথাগোঁজার ঠাঁইসহ সহায়-সম্বল। এমন দশায় পরিবার নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন তিনি।
রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমার ঘরবাড়ি সব নদীতে ভাইঙা নিয়া গেলো। কিছুই সরাইতে পারলাম না। লোকজন ডাক দেয়ার আগেই সব নদীতে তলাইয়া গেলো। কোনোমতে জানডা লইয়া বাহির হইছি। কই যামু, কী খামু আল্লাহ জানে।’
রোকেয়া বেগমের মতো একই দশা ওই এলাকার আয়নাল মাদবর, রুবেল মাদবর, মাহাবুব মাদবরসহ আরও পাঁচটি পরিবারের। গতকাল রাতের ভাঙনে হারিয়েছেন বসতঘর। আবার অনেকে ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নিচ্ছেন ঘরবাড়ি। তাদের অভিযোগ, তিনদিন আগে মৃদু ভাঙন দেখা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়। তারপরও পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভাঙনে সহায়-সম্বল হারিয়েছেন তারা।
রুবেল মাদবর বলেন, ‘চাইছিলাম একটা বেড়িবাঁধ, যাতে বাপের কালের জমিজমা লইয়া বাঁচতে পারি। কিন্তু বেড়িবাঁধের প্রকল্প শুরু হলেও আমাগো এদিকে একটুও কাজ করে নাই ঠিকাদারের লোকজন। আইজ আমাগো ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি সব নদীতে তলাইয়া গেলো। আমরা এখন আর কার কাছে কী চামু?’

আয়নাল মাদবর নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘কিছুই বাইর করতে পারি নাই। কিছুই ধরতে পারলাম না। যা আছিলো সব নদীতে লইয়া গেলো। কয়েকদিন আগে ভাঙন দেখা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানাইছি। তারা আইসা দেইখা গেছে। কিন্তু জিওব্যাগ ফালায় নাই। তারা যদি সেদিন কাজ করতো, তাহলে আমাগো ঘর বাড়ি যাইতো না।’
এ বিষয়ে জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ তারেক হাসান বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে জিওব্যাগ ডাম্পিং অব্যাহত রয়েছে। ডানতীর নদী রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের ভাঙন এলাকায় জিওব্যাগ ডাম্পিং করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। কালকের মধ্যে কাজ শুরু করার আশ্বাস দিয়েছেন তারা।’
বিধান মজুমদার অনি/এসআর/জিকেএস