ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

টেকসই পর্যটনের নতুন দিগন্ত টি-ট্যুরিজম

ওমর ফারুক নাঈম | মৌলভীবাজার | প্রকাশিত: ০১:১৪ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আজ ২৭ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘টেকসই উন্নয়নে পর্যটন’। এই প্রতিপাদ্যের আলোকে বিশ্বজুড়ে যখন টেকসই ও দায়িত্বশীল পর্যটনের বিষয়ে আলোচনা চলছে তখন ট্যুরিজমে অপার সম্ভাবনা মেলে ধরছে মৌলভীবাজার জেলা।

চা বাগানের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, পাহাড়ি জনপদের আদিম শুদ্ধতা, বৈচিত্র্যময় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি মিলিয়ে মৌলভীবাজার এখন শুধু দর্শনের নয় টেকসই পর্যটনে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে টি-ট্যুরিজম ইতোমধ্যেই স্থানীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, টি-ট্যুরিজম এখন স্থানীয় অর্থনীতি, নারী উদ্যোক্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সংস্কৃতির টেকসই চর্চার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। পর্যটনের এই নতুন ধারা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনে যেমন আনছে কর্মসংস্থানের সুযোগ, তেমনি পর্যটকদের জন্যও তৈরি করছে ভিন্নধর্মী এক অভিজ্ঞতার জগৎ।

টেকসই পর্যটনের নতুন দিগন্ত টি-ট্যুরিজম

মৌলভীবাজারের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে চা শিল্প ও গ্রামীণ জীবনধারা। চা পাতা তোলার দৃশ্য, প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা কিংবা সদ্য তৈরি চায়ের স্বাদ গ্রহণ করা পর্যটকদের কাছে ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। চা পাতার সুভাস ঘেরা এই জনপদে এখন বাড়ছে টি-ট্যুরিজমের জনপ্রিয়তা। দেশি-বিদেশি ভ্রমণকারীরা শুধু প্রকৃতি উপভোগ করছেন না, বরং হাতে কলমে অংশ নিচ্ছেন চা সংগ্রহে। কখনও চা-কারখানায় গিয়ে দেখছেন প্রক্রিয়াজাতকরণের ধাপ আবার কখনও স্থানীয়দের সঙ্গে বসে উপভোগ করছেন চা।

শ্রীমঙ্গলের নীল কণ্ঠ টি কেবিনে বসে চা খাচ্ছেন ঢাকা থেকে আসা পর্যটক নাবিল আহমদ।

তিনি বলেন, এখানে এসে মনে হচ্ছে একেবারে অন্য জগতে চলে এসেছি। সবুজ চা বাগান, প্রকৃতির নীরবতা সব মিলিয়ে এক অপূর্ব পরিবেশ। সবচেয়ে ভালো লেগেছে স্থানীয়দের সঙ্গে বসে চা পানের অভিজ্ঞতা। শুধু দৃশ্য নয়, মানুষের আন্তরিকতা আর আতিথেয়তাও আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে।

বাংলাদেশিয় চা সংসদের সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান জিএম শিবলী বলেন, মৌলভীবাজারকে বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী বলা হয়। এখানকার চা শুধু দেশের অর্থনীতির সঙ্গে নয়, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। পর্যটন ও চা শিল্পকে একসঙ্গে যুক্ত করলে দেশের জন্য তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা। টি-ট্যুরিজমের মাধ্যমে স্থানীয়রা যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের চায়ের সুনামও ছড়িয়ে পড়ছে। তবে এজন্য সরকার, উদ্যোক্তা ও স্থানীয়দের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে মৌলভীবাজার হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মানের টি-ট্যুরিজম হাব।

টেকসই পর্যটনের নতুন দিগন্ত টি-ট্যুরিজম

চা-বাগান আর পাহাড়কে ঘিরে মৌলভীবাজারে বসবাস করছে ২৯টি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনধারা, পোশাক- লোকগান ও ঐতিহ্য ভ্রমণকারীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠছে। অনেকে স্থানীয়দের বাড়িতে হোমস্টে করছেন, দেশি খাবার খাচ্ছেন, আবার বসছেন গানের আসরে। এভাবেই গড়ে উঠছে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম, যা স্থানীয়দের জন্য তৈরি করছে আয়ের নতুন সুযোগ।

কমলগঞ্জের ভানুবিল মাঝের গাঁও মনিপুরী কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম মাঙাল ময়ুম’র উদ্যোক্তা নিরঞ্জন সিংহ বলেন, আমরা চাই পর্যটকরা শুধু ঘুরে চলে না যাক। আমরা চাই, আমাদের সংস্কৃতি, লোকজ ঐতিহ্য, গান, নৃত্য আর খাবারের স্বাদও যেন তারা উপভোগ করুক। এতে একদিকে পর্যটকদের জন্য তৈরি হচ্ছে ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে আমাদের কমিউনিটির মানুষ পাচ্ছেন আয়ের সুযোগ। বিশেষ করে নারী ও তরুণরা এখন ঘরে বসেই পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছেন।

সেন্টমার্টিনে এখনো গত মৌসুমের হতাশার ছাপ

মৌলভীবাজারে বর্তমানে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ইকো-বেইজড রিসোর্ট। এসব রিসোর্টে নির্মাণে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত সবুজের সমন্বয়। ফলে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখেই পর্যটকরা পাচ্ছেন আধুনিক আবাসনের সুবিধা। ব্যবসায়ীদের জন্যও এসব রিসোর্ট তৈরি করছে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ।

টেকসই পর্যটনের নতুন দিগন্ত টি-ট্যুরিজম

আরও পড়ুন: বিশ্ব পর্যটন দিবস আজ

অরণ্যনিবাস ইকো রিসোর্টের পরিচালক ফায়কুজ্জামান বাদশা বলেন, ইকো ট্যুরিজম এখন শুধু পর্যটকদের জন্য নয়, ব্যবসায়ীদের জন্যও নতুন সুযোগ তৈরি করছে। আমরা যখন অরণ্যনিবাস গড়ে তুলি, তখন মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে ভ্রমণকারীদের আধুনিক আবাসনের অভিজ্ঞতা দেওয়া। এজন্য রিসোর্টে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আর স্থানীয় সংস্কৃতির উপাদানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পর্যটকরা একদিকে প্রকৃতির কাছে থাকতে পারছেন, অন্যদিকে আমাদের স্থানীয় অর্থনীতিও উপকৃত হচ্ছে। যদি সরকারি সহায়তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন আরও বাড়ানো যায়, তাহলে মৌলভীবাজার আন্তর্জাতিক মানের একটি ইকো-ট্যুরিজম ডেসটিনেশন হয়ে উঠতে পারবে।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্ভাবনার জায়গা মৌলভীবাজার। সঠিক পরিকল্পনা আর অবকাঠামো উন্নয়ন হলে টি-ট্যুরিজম হতে পারে এই জেলার উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। পর্যটন বিকাশে বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ নিয়েছে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন। সম্প্রতি ‘চায়ের দেশ’ নামে একটি তথ্যভাণ্ডার ওয়েব পোর্টাল চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, পর্যটন স্পট, রিসোর্ট, স্থানীয় সংস্কৃতি ও খাবারসহ পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া ভ্রমণকারীদের জন্য আধুনিক আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে ট্যুরিজম বোর্ড একটি থ্রিস্টার মানের মোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও রাস্তাঘাট ও খাসিয়া-মণিপুরী পুঞ্জির যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

ওমর ফারুক নাঈম/এনএইচআর/এএসএম