ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

পেঁয়াজ চাষে হতাশা বাড়াচ্ছে সার ‘সিন্ডিকেট’

আলমগীর হোসাইন | পাবনা | প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পাবনা সদর ও সুজানগরের পদ্মার চরসহ অধিকাংশ নিচু জমি থেকে সরে গেছে বর্ষার পানি। জমিতে আসতে শুরু করেছে জো। আর মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদের মৌসুম শুরু হবে। এর জন্য আগের থেকেই জমি লিজ নেওয়া, বীজ সংগ্রহ ও অন্যান্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন এসব অঞ্চলের কৃষকরা। কিন্তু আবাদের শুরুতেই যেটির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি-সেই সার নিয়েই চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের।

খুচরা দোকানি বা অনুমোদিত ডিলারের কাছে গিয়ে সার সংকটের গল্প শুনতে হচ্ছে তাদের। তবে সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরে অতিরিক্ত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে মিলছে সার। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ডিলারের থেকেও মিলছে সার, তবে সেটির ক্ষেত্রেও কোনো কোনো সারের বস্তা প্রতি গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৭০০ টাকা পর্যন্ত। এতে চলতি মৌসুমে বিঘা প্রতি প্রায় ৫ হাজার টাকা করে খরচ বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি কৃষকদের। ফলে অতীতে যেমন ফলন ও বাজারমূল্যের দুরবস্থায় ভুগেছেন, এবারও সেই চিত্রের পুনরাবৃত্তি হবে কি না-সে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে কৃষকদের।

সদর উপজেলার চরতারাপুর ইউনিয়নের কোলচরী গ্রামের কৃষক বাকু খাঁ। গতবছর তিনটি গরু বিক্রি করে পদ্মার চরের ৬ বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন তিনি। এতে মোট খরচ হয়েছিল ৭ লাখ টাকার মতো। কিন্তু দাম ও ফলন ভালো না পাওয়ায় এর বিপরীতে পেঁয়াজ বিক্রি করে আড়াই লাখ টাকার মতো পেয়েছিলেন বলে দাবি করেন তিনি। বাকি পুরোটাই লোকসানের খাতায় যায়।

পেঁয়াজ চাষে হতাশা বাড়াচ্ছে সার ‘সিন্ডিকেট’

তবে এবার আগের মতো আবাদের সামর্থ্য নেই। ফলে সর্বোচ্চ তিন বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। বীজ ও জমি লিজসহ অন্যান্য প্রস্তুতিও নিয়েছেন। তবে পেঁয়াজের বীজ রোপণের শুরুতেই লাগবে বাংলা ড্যাপ (ডিএপি) সার। তাই সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার কিনতে বিভিন্ন দোকানি বা ডিলারের কাছে যান তিনি। কিন্তু সার সংকট আর অতিরিক্ত দামের কথা শুনে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

কৃষক বাকু খাঁ বলেন, ১ হাজার ৫০ টাকার বিএডিসি ড্যাপের দাম নেয়া হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকা, ১ হাজার ৫০০ টাকার বাংলা ড্যাপে বেশি নেয়া হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকা। একইভাবে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদের সময় সব সার ও কীটনাশকেই দাম বাড়ানো হয়েছে। গতবছর বিঘায় সার কীটনাশক বাবদ ব্যয় ছিল সাড়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। কিন্তু এবার ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ পড়বে। অর্থাৎ বিঘায় প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ বাড়বে।

তিনি বলেন, সার নিয়ে কারসাজি শুধু খরচ বাড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বাজারে সংকট সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত সার মিলছে না। ফলে আবাদে দেরি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। দেরিতে রোপণ করলে ও সার দেয়াসহ পর্যাপ্ত পরিচর্যা না করলে পেঁয়াজের ফলন কম হয়। আবার পেঁয়াজ দেরিতে বাজারে উঠলে দামও কম মিলবে। এভাবেই আমরা বছরের পর বছর লোকসানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দাবি, সরকারি দামে পর্যাপ্ত সার বাজার থেকে যেনো আমরা কিনতে পারি সেই ব্যবস্থা করে দেয়া হোক।

পেঁয়াজ চাষে হতাশা বাড়াচ্ছে সার ‘সিন্ডিকেট’

কৃষক ও বাজার সূত্র থেকে জানা গেছে, আবাদের মৌসুম শুরু হবার কয়েক মাস আগের থেকেই একটি অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এজন্য মৌসুম শুরু হবার আগে থেকেই কৃষক ও খুচরা দোকানি পর্যায়ে সার সংকটের গল্প ছড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর মৌসুমে আবাদের সময় এ সংকটকে কাজে লাগিয়ে প্রায় প্রতিটি সার ও কীটনাশকের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে পাবনার বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাপক মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও আগাম সবজির আবাদ শুরু হওয়ায় সার ও কীটনাশকের চাহিদা বেড়েছে। এটাকে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের সুযোগ হিসেবে নিয়ে সারের দাম অতিরিক্ত বেশি নেয়া হচ্ছে।

বর্তমানে সদর ও সুজানগর উপজেলাসহ পাবনায় কোনো সার সরকার নির্ধারিত দামে মিলছে না। ১ হাজার ৫০০ টাকার বাংলা ড্যাপ ২ হাজার ২০০, ১ হাজার ৫০ টাকার বিএডিসি ড্যাপ ১ হাজার ৩৮০ থেকে ১ হাজার ৪০০, ১ হাজার টাকার এমওপি ১ হাজার ১৫০ ও ১ হাজার ৩৫০ টাকার টিএসপি ১ হাহার ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এভাবে ইউরিয়া সারসহ অন্যান্য সার বস্তায় একইভাবে বিভিন্ন বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। কেজি বা খুচরা হিসেবে এ দাম আরও বেশি। সুযোগ বুঝে দাম বেশি নেয়া হচ্ছে কীটনাশকেও।

এদিকে এর প্রতিবাদে সম্প্রতি পাবনার চরতারাপুর ইউনিয়নের কোলচরী বাহিরচরে প্রতীকী কর্মবিরতিও পালন করেছেন কৃষকরা।

তাদের অভিযোগ, সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন সারের সংকট নেই জানালেও ব্যবসায়ীরা সংকট উল্লেখ করে তাদের থেকে দাম বেশি নিচ্ছেন। কিন্তু তাতে তেমন কার্যকরী ভূমিকা নেয়া হচ্ছে না। এক্ষেত্রে দ্রুত সারের বাজারে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার দাবি কৃষকদের।

পেঁয়াজ চাষে হতাশা বাড়াচ্ছে সার ‘সিন্ডিকেট’

কৃষক মো. বাপ্পী বলেন, ডিলারের কাছে গেলে বলে সার নেই। কিন্তু ভিন্নভাবে গিয়ে অতিরিক্ত দাম দিলে আবার সার মেলে। আর খুচরা বাজারে তো বেশি দামে সার অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এগুলো কৃষি অফিস বা প্রশাসন দেখে না। ঠিকমতো দেখাশোনা ও ব্যবস্থা নিলে এই সমস্যা থাকে না। কিন্তু সেটা নেয়ার মানুষই দেখি না।

আরেক কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, সরকার বলে সারের অভাব নেই। অথচ আমরা বাজারে গেলে বরে সারের সাপ্লাই কম। এজন্য প্রতি বস্তা সারে ১৫০ থেকে শুরু করে বিভিন্ন হারে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো হয়েছে। পেঁয়াজ রোপণের শুরুতেই ৫০ কেজির এক বস্তা করে সার দেয়া লাগে। কিন্তু যে হারে এর দাম ধরা হয়েছে তাতে কৃষকের আরও কয়েকটা গরু বিক্রি করে অথবা ঋণ নিয়ে আবাদে আসা লাগবে।

তিনি বলেন, পেঁয়াজ উঠার পর দামের সময় বাইরের দেশ থেকে আমদানি করে কৃষকের লোকসানে ফেলে। আবার আবাদের সময় সার বীজের সংকটেও রাখে। কৃষকের অসুবিধা দেখার মত কেউ নেই।

আরও পড়ুন:

১০১ টাকার ওষুধ ১৩০০ টাকায় কিনলো কুমেক হাসপাতাল
তিন মাস ধরে পানি না পেলেও বিল গুনছেন গ্রাহকরা

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা জানান, সরকারি রেট অনুযায়ী বিএডিসি ড্যাপ সারের দাম কেজি প্রতি ২১ টাকা। কিন্তু এর থেকে অনেক বেশি দামে কেনার কারণে ২৮ টাকা করে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। একইভাবে অন্যান্য সারও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। বড় বড় সার দোকানদার বা ডিলাররা সঠিক দামে সার না ছাড়ায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। সার কেনার রশিদ চাইলে সেটি না দিয়ে সাদা কাগজে বিল লিখে দেন তারা। এর বেশি কিছু চাইলে সার নেই বলে দেয় না। তাই বাধ্য হয়েই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের।

এ বিষয়ে সুজানগর বাজারের বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজের মো. মিঠুন বলেন, সরকারি মূল্যেই আমরা সার কীটনাশক বিক্রি করছি। সরাসরি কৃষকরাও নিচ্ছেন। সারের কোনো সংকট নেই। তবে আপাতত আমার এখানে বাংলা ড্যাপ সার নেই।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক বলেন, পাবনা সদরে ১৯, সুজানগরে ১১ ও ঈশ্বরদী উপজেলায় ১০টিসহ ৯টি উপজেলার ২৪৭টি বিসিআইসি ডিলারের মাধ্যমে কৃষকের সারের চাহিদার যোগান দেয়া হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত বাজারে সারের কোনো সংকট নেই। অতিরিক্ত দাম নেওয়ার কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে যদি কেউ বেশি দাম রাখে তবে তাদের বিষয়ে কোনো ছাড় নেই। অবশ্যই তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

এনএইচআর/এমএস