বগুড়া-৩
তালুকদার পরিবারের প্রতি টান প্রবীণদের, নতুনরা চান পরিবর্তন
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে বগুড়া-৩ (আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া) আসন। এলাকার রাজনৈতিক ইতিহাস ও নির্বাচনী ফল বলছে, এই আসনে বিএনপি দীর্ঘকাল ‘রাজনৈতিক আধিপত্য’ ধরে রেখেছে। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১২টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে বিএনপি জয় পেয়েছে ছয়বার। অন্যদের মধ্যে জাতীয় পার্টি তিনবার, আওয়ামী লীগ একবার, জাসদ একবার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী একবার। কিন্তু এবারের নির্বাচনকে ঘিরে সমীকরণ জটিল হয়ে উঠেছে।
ইতিহাসে ফিরে দেখা ‘তালুকদারদের’ দুর্গ
বগুড়া-৩ আসনের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে রাজত্ব করে এসেছে বিএনপির প্রভাবশালী তালুকদার পরিবার। ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে টানা প্রায় তিন দশক (২০০৮ সাল পর্যন্ত) পাঁচটি নির্বাচনে এই আসনে জয়ী হয়েছেন কেবল বিএনপির প্রার্থীরাই। হাজী আব্দুল মজিদ তালুকদার ছিলেন এই আসনের কিংবদন্তিতুল্য নাম। তিনি ছিলেন বিএনপির প্রথম সারির নেতা এবং একাধারে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি ছেলে আব্দুল মোমিন তালুকদার খোকাও দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাবার আসন ধরে রাখেন।
অবশ্য ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কিছুটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেবার বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মেজর জেনারেল (অব.) গোলাম মওলা অল্প সময়ের জন্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপরও স্থানীয় ভোটারদের কাছে এই আসন আজও ‘তালুকদার পরিবারের আসন’ নামেই বেশি পরিচিত। আগামী নির্বাচনে বিএনপি আবারও শক্ত অবস্থানে মাঠে নামছে। তালুকদার পরিবারের নতুন প্রজন্ম থেকে আসছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মহিত তালুকদার। তিনি সরাসরি দাবি করছেন, এই আসনের নেতৃত্ব তারাই বহন করবেন।
মহিত তালুকদার বলেন, এলাকার মানুষ এই পুরিবারের হাতেই নেতৃত্ব দিতে চান। মানুষ তাদেরকে ভালোবাসেন। তারাও মানুষের জন্য কাজ করেন। দল নিশ্চয়ই এই বিষয়টি মূল্যায়ন করবে।
তবে শুধু তিনি নন, মনোনয়ন পেতে এরইমধ্যে সক্রিয় হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা। তাদের মধ্যে আছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলুল বারী তালুকদার বেলাল। তিনি বলেন, এরআগেও তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। এবার দল যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই তিনি মেনে নেবেন।
বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট হামিদুল হক হিরু বলেন, ‘আমি প্রার্থী হয়েছি এলাকার ভোটারদের অনুরোধে। মানুষ চাচ্ছে একটা পরিবর্তনের। আমি তারপরও বলছি, আমাদের নেতা তারেক রহমান যে সিদ্ধান্ত নেবেন, আমরা সেটি মাথা পেতে নেবো’।’
প্রার্থী তালিকায় আরও রয়েছেন বগুড়া বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান খান মুক্তা, সাবেক পৌর মেয়র তোফাজ্জল হোসেন ভুট্টু, পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি ফিরোজ মোহাম্মদ কামরুল হাসান এবং বিএনপির প্রবাসী কল্যাণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান।
প্রতিটি নামই স্থানীয় রাজনীতিতে পরিচিত এবং তাদের নিজস্ব গোষ্ঠী-সমর্থক রয়েছে। কেউ কেউ ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন, আবার কারও প্রভাব ছাত্রদল ও যুবদলের ভেতরেও প্রবল। ফলে এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া সহজ হবে না। বরং দলীয় টিকিটকে ঘিরে যে লড়াই হবে তা হবে ভেতরের আসল ‘ভোটযুদ্ধ’।
জামায়াতের একক প্রার্থী
বগুড়া-৩ আসনে বিএনপির ভেতরের মনোনয়ন প্রতিযোগিতা যতটা তীব্র, মাঠ পর্যায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উপস্থিতিও ততটাই দৃশ্যমান। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এরইমধ্যে দুপচাঁচিয়া উপজেলার গুনাহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ আবু তাহেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে তিনি বেশ পরিচিত মুখ এবং চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় সংগঠন ও ভোটারদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছেন। মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিনই তিনি আদমদীঘি ও দুপচাঁচিয়ার বিভিন্ন গ্রামে উঠান বৈঠক করছেন। হাটবাজারে লিফলেট বিতরণ এবং মসজিদভিত্তিক যোগাযোগকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন জামায়াতের এই প্রার্থী। এতে করে জামায়াতের সংগঠিত ‘ভোটব্যাংককে’ সক্রিয় রাখার পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের কাছেও উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন তিনি।
নুর মোহাম্মদ আবু তাহের বলেন, ‘সাধারণ মানুষ আমাদের পক্ষে রয়েছেন। তারা এবার ভিন্ন কিছু দেখতে চান।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে কাজ করায় জামায়াতের সমর্থন এখন আগের চাইতে অনেক বেশি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিপুল ভোটে জয়লাভ করবো।’
আরও পড়ুন:
বিএনপির ঘাঁটি উদ্ধারে বাধা অনৈক্য, সুযোগ নিতে চায় জামায়াত
‘বিএনপির ঘাঁটি’তে ফ্যাক্টর মান্না-জামায়াতের শাহাদাতুজ্জামান
বিএনপির ঘাঁটিতে জয়ের স্বপ্ন জামায়াতের
জামায়াতসহ ৫ দলে একজন করে প্রার্থী, বিএনপিতে ছড়াছড়ি
বিএনপির মনোনয়ন চান চার নেতা, একক প্রার্থীতে উজ্জীবিত জামায়াত
ডাকসু-জাকসু : জাতীয় নির্বাচনের মহড়া?
শুধু জামায়াত নয়, বেশ নীরবে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলের প্রার্থী শাহাজাহান আলী তালুকদার এবং তার কর্মী বাহিনী নিয়মিত গণসংযোগে ব্যস্ত। তারা গ্রামে গ্রামে দাওয়াতি কার্যক্রম, মসজিদভিত্তিক প্রচারণা এবং স্থানীয় ইস্যু ঘিরে ছোটখাটো সভা করে জনমত তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলনের ভোটের হিসাব হয়তো বড় পরিসরে প্রভাব ফেলবে না, তবে তাদের ধারাবাহিক মাঠপর্যায়ের তৎপরতা ভোটের দিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে বড় কোনো দলের প্রার্থীর ভোট ভাগাভাগির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের এই সক্রিয়তা ভোটের অংকে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
আওয়ামী লীগ নেই, জাপার নীরবতা
এই আসনে আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় ফলে নির্বাচনী মাঠে তাদের অবস্থান কার্যত শূন্যের কোঠায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, আওয়ামী লীগ নেই মানেই ভোটের সমীকরণে এক বড় ফ্যাক্টর বাদ পড়ে গেছে।
অতীতে এই আসনে কিছুটা জায়গা করে নিতে পেরেছিল জাতীয় পার্টি (জাপা)। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাপার প্রার্থী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম তালুকদার টানা দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু এলাকায় স্থায়ী জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করতে পারেননি তিনি। অনেক ভোটার মনে করেন, তার বিজয় মূলত প্রধান দুটি দলের অনুপস্থিতি ও নির্বাচনী সমঝোতার কারণে হয়েছিল, ব্যক্তিগত প্রভাবের কারণে নয়। তাই ২০২৬ সালের নির্বাচনে জাপাকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছেন না স্থানীয়রা।
২০২৪ সালের নির্বাচনে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল্লাহ আল মেহেদী বাঁধন দুই দলের নীরব সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে তিনি কোন দলের ঘনিষ্ঠ, ভবিষ্যতে কোন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবেন তা এখনো অস্পষ্ট। এ অনিশ্চয়তা ভোটের আগে নতুন অংক তৈরি করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি বিএনপি ও জামায়াত আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়, তবে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে ভোটের মাঠে ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী উঠে আসতে পারেন। সাধারণত এ ধরনের প্রার্থী হয়ে থাকেন স্থানীয় কোনো বড় ব্যবসায়ী, জনপ্রিয় সামাজিক নেতা বা ক্ষমতাসীন দলের অঘোষিত সমর্থন পাওয়া কেউ। স্বতন্ত্রের মোড়কে তাদের উপস্থিতি সরাসরি ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
যা বলছেন ভোটাররা
বগুড়া-৩ আসনে ভোট ভোটার তিন লাখ ২২ হাজার ১৬৭ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৬০ হাজার ৯১১ জন। নারী ভোটার এক লাখ ৬১ হাজার ২৫৬ জন। এখন আসনের ভোটারদের মুখে সবচেয়ে বেশি ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি প্রশ্ন—আবারও তালুকদার, না কি নতুন কেউ? দুপচাঁচিয়ার চা দোকানি আবু জাফর বলছিলেন, ‘তালুকদারদের আমরা চিনি। তারা এমপি হইলে এলাকায় কিছু কাজ হয়। তবে এখনকার ছেলেপেলেরা অন্য নেতাকেও দেখতে চায়। সবাইতো আর আগের মতো ভোট দেয় না।’ তার কথায় পুরোনো রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, আবার নতুন নেতৃত্বের জন্য কৌতূহলও স্পষ্ট।
একই উপজেলার কৃষক ইউনুস আলী বললেন, ‘আমার ভোট আমি যারে চাই তাকে দেবো। উন্নয়ন হইলেই খুশি। আগে বিএনপি ছিল, এখন দেখি সবাই দৌড়াইতাছে। আমার কাছে দলীয় পরিচয়ের চেয়ে কাজের হিসাবই বড় বিষয়।’
তরুণ ভোটার মিনার উদ্দিন বলেন, ‘ফেসবুকে দেখি অনেকেই নিজেদের পক্ষে পোস্ট দিচ্ছে, ভিডিও বানাচ্ছে, ব্যানার শেয়ার করছে। তবে পুরান ভোটাররা তালুকদারদের ভালো জানে। তাদের টান এখনো আছে।’
এমন কথাবার্তায় বোঝা যায়, পুরোনো ভোটাররা এখনো তালুকদার পরিবারের দিকে ঝুঁকে থাকলেও তরুণ প্রজন্ম বিকল্প নেতৃত্বের খোঁজ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণা, প্রার্থীদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ আর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিই এবার ভোটের মাঠে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।
বগুড়া-৩ আসনটি শুধু ভোটের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। এখানে পরিবারগত প্রভাব, দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, স্থানীয় গোষ্ঠীভিত্তিক আনুগত্য আর আদর্শিক অবস্থান সব মিলিয়ে তৈরি হয় বিশেষ এক সমীকরণ। তালুকদার পরিবারের নাম, জামায়াতের সংগঠিত ‘ভোট ব্যাংক’, স্বতন্ত্র প্রার্থীর সম্ভাবনা সব মিলে প্রতিবারই ভোটের রং বদলায়।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ আব্দুল কাদের বলেন, ‘বগুড়া-৩ আসনটি শুধু ভোটের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না; এখানে পরিবারগত প্রভাব, দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, স্থানীয় গোষ্ঠীভিত্তিক আনুগত্য আর আদর্শিক অবস্থান—সবমিলিয়ে তৈরি হয় বিশেষ এক সমীকরণ। তালুকদার পরিবারের নাম, জামায়াতের সংগঠিত ভোটব্যাংক, স্বতন্ত্র প্রার্থীর সম্ভাবনা মিলে প্রতিবারই ভোটের রং বদলায়।’
তিনি বলেন, ‘এই আসনে কে হবেন বিজয়ী তা নির্ধারণ করবে মূলত দুটি বিষয়—বহু পুরোনো গণসংযোগের ঐতিহ্য আর গোষ্ঠী পরিচিতির টানাপোড়েন। পুরোনো ভোটারদের আবেগ আর তরুণ প্রজন্মের পরিবর্তনের ইচ্ছা—এই দুইয়ের সংঘাতই এবার আসল প্রেক্ষাপট তৈরি করবে।’
এসআর/এমএমএআর/এমএস
সর্বশেষ - দেশজুড়ে
- ১ ফ্যাসিবাদী আমলে বন্ধ হওয়া চিনিকলগুলো পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিয়েছি
- ২ ৮০০ টাকা কেজি রান্না করা গরুর মাংস কিনতে ক্রেতাদের হিড়িক
- ৩ পুরোনো রাজনীতি পরিহার করে নতুন রাজনীতি করতে চাই: মঞ্জু
- ৪ ফ্যাসিবাদের আমলে ৫ টাকা চাঁদা দিলে এখন ২০ টাকা দেওয়া লাগে
- ৫ রাজমিস্ত্রির বাড়ি থেকে ওয়ানশুটার গানসহ দুই পিস্তল উদ্ধার