ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ঝিনাইদহ

কাজে লাগে না ‘হাত ধোয়া’বেসিন, কলে আসে না পানি

শাহজাহান নবীন | ঝিনাইদহ | প্রকাশিত: ০২:২৬ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

শাহিনুর রহমান, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের বাসিন্দা। জেলা শহরে এসেছেন বিশেষ কাজে। শহরের পায়রা চত্বরে খোঁজ করছিলেন নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার জায়গা। পায়রা চত্বরের পাশেই বটতলায় বসানো ঝিনাইদহ পৌরসভার নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার বেসিনের সামনে গিয়ে তিনি রীতিমতো হতাশ। লোহার মিনারের ওপরে বসানো পানির ট্যাংকি, নিচে ধাতব বেসিন। তবে তাতে পানি না নেই। উপায় না পেয়ে শেষে পাশের দোকানে ধরনা দিতে হয় তাকে।

প্রতিদিন গ্রাম থেকে শহরে আসা অসংখ্য মানুষ এভাবেই নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার জন্য খুঁজে ফেরেন নির্ধারিত জায়গা। করোনাকালীন শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার ব্লক সচল থাকলেও এখন তা অকেজো।

একই অবস্থা জেলার হরিণাকুণ্ডু, মহেশপুর, কোটচাঁদপুরসহ ৬টি উপজেলা শহরে। গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষগুলো প্রতিনিয়ত পড়ছেন বিড়ম্বনায়। কোনো কোনো বেসিন ব্লকে পানির কল বা ট্যাপ আছে ঠিকই, নেই পানির প্রবাহ। ফলে মলিন মুখে নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার জায়গার সন্ধান করতে বাধ্য হন শহরে চলাচলকারীরা।

করোনাকালে স্থাপিত ‘হাত ধোয়া’ বেসিন অকেজো, কলে আসে না পানি

আরও পড়ুন:
ইন্টারনেট আসক্তিতে বাড়ছে তরুণদের মানসিক চাপ
চিনিকলের বর্জ্য নদীতে, মরে ভেসে উঠছে মাছ

সরেজমিন ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঝিনাইদহে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও হাত ধোয়া কেন্দ্রগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। জেলার ৬টি উপজেলা, পৌরসভা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য বিভাগের তৈরি করা এসব নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়া কেন্দ্র এখন কোনো কাজেই আসছে না। অধিকাংশ হাত ধোয়ার বেসিন ও পানির লাইন বিকল হয়ে পড়ে আছে। এ ছাড়া জেলার প্রায় সাড়ে চারশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৃথক সরকারি প্রকল্পের আওতায় বসানো হাত ধোয়ার বেসিন ও নিরাপদ পানির লাইন বসানো হয়। যার প্রায় ১০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে।

‘ওয়াশ ব্লকের কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। কিছুদিন পরেই পানি ট্যাপ নড়বড় করে। পাইপ খুলে পড়ে। এ ছাড়া আয়রন ও আর্সেনিকমুক্ত পানির জন্য নলকূপ বসানো হলেও পানিতে আয়রন পাওয়া যাচ্ছে। যে সব স্কুলে ওয়াশ ব্লক হয়েছে, তার সব জায়গাতেই প্রায় একই অবস্থা।’

জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে জেলার ৬টি উপজেলা ও পৌর শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল এলাকায় মোট প্রায় ২১টি নিরাপদ খাবার পানির ডিপো বসানো হয়। একই সঙ্গে ওই সব পয়েন্টে রাখা হয় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। করোনাকালীন লকডাউন চলাকালে পানি সরবরাহের এসব জায়গা থেকে মানুষ সেবা নিয়েছেন। কিন্তু লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি শিথিল করার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার এসব পয়েন্ট কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সংরক্ষণের অভাবে এসব হাত ধোয়ার বেসিন, পানির লাইন, পানি উত্তোলনের মোটর ও ট্যাংকি নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও চুরি হয়ে গেছে নিরাপদ পানি উত্তোলনের বৈদ্যুতিক মোটর। অযত্ন অবহেলায় হাত ধোয়ার নির্ধারিত এসব জায়গা এখন যেন ময়লার ভাগাড়।

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার হরিণাকুণ্ডু, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, শৈলকূপা ও কালীগঞ্জ উপজেলায় ৩টি করে নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এসব কেন্দ্র স্থাপন করে পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ চত্বরে। প্রতিটি কেন্দ্র নির্মাণ বাবদ খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া ঝিনাইদহ সদর উপজেলা ও জেলা শহরে প্রায় ৬টি জনবহুল স্থানে বসানো হয় নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার কেন্দ্র। প্রতিটি কেন্দ্র এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, জেলার প্রায় সাড়ে চারশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরই মধ্যে পিইডিপি-৪ প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার বেসিন বসানো হয়েছে। ধাপে ধাপে প্রকল্পের আওতায় জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এই সেবা নিশ্চিত করবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তা সচল রয়েছে বলে দাবি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের।

করোনাকালে স্থাপিত ‘হাত ধোয়া’ বেসিন অকেজো, কলে আসে না পানি

হরিণাকুণ্ডু উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল আমিন জানান, উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর তিনটি স্পটে নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন করে। এখন পর্যন্ত সবগুলোই সচল রয়েছে। তবে মানুষ আগের মতো ব্যবহার করে না। উপজেলা মোড়, হাসপাতাল মোড় ও বড় বাজারে ৩টি ওয়াশ ব্লক স্থাপন করা হয় বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন:
ঝিনাইদহে রোপা আমন ক্ষেতে পচন সংক্রমণ, দিশাহারা কৃষক
কলা-পান পেরিয়ে ড্রাগন-মাল্টায় রঙিন স্বপ্ন কৃষকের

তবে সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। পিইডিপি-৪ প্রকল্পের আওতায় যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার বেসিন (ওয়াশ ব্লক) বসানো হয়েছে, তা অনেক জায়গায় নষ্ট হয়ে আছে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় কোথাও কোথাও ভেঙে পড়ে আছে বেসিন। কোনো কোনো স্কুলে পানির কল বা ট্যাপ নষ্ট হয়ে আছে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

‘করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রত্যেকটি পৌরসভা ও উপজেলা নিজস্ব অর্থায়নে নিরাপদ পানি ও হাতধোয়ার অস্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল তাদের। তবে করোনাকালীন লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি শিথিল হওয়ার পর ওইসব নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার কেন্দ্রগুলো মানুষ আর ব্যবহার করে না।’

এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরেও বসানো হয়েছিল হাত ধোয়ার বেসিন। যার ৯০ শতাংশ এরই মধ্যে ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওয়াশ ব্লকের কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। কিছুদিন পরেই পানি ট্যাপ নড়বড় করে। পাইপ খুলে পড়ে। এ ছাড়া আয়রন ও আর্সেনিকমুক্ত পানির জন্য নলকূপ বসানো হলেও পানিতে আয়রন পাওয়া যাচ্ছে। যে সব স্কুলে ওয়াশ ব্লক হয়েছে, তার সব জায়গাতেই প্রায় একই অবস্থা।

কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, সরকারি কাজ সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া হলে কাজের মান ভালো হতো। ঠিকাদারের লোকজন নয়ছয় বুঝিয়ে কাজ করে চলে যায়। এরপর কাগজে কলমে প্রজেক্ট থাকে, সেবা বঞ্চিত হয় মানুষ। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে ওয়াশ ব্লক নির্মাণের কাজ সঠিকভাবে হওয়া উচিত।

করোনাকালে স্থাপিত ‘হাত ধোয়া’ বেসিন অকেজো, কলে আসে না পানি

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকমল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রত্যেকটি পৌরসভা ও উপজেলা নিজস্ব অর্থায়নে নিরাপদ পানি ও হাতধোয়ার অস্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল তাদের। তবে করোনাকালীন লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি শিথিল হওয়ার পর ওইসব নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার কেন্দ্রগুলো মানুষ আর ব্যবহার করে না।

তিনি আরও বলেন, বিশেষ পরিস্থিতি ও সময়ের প্রয়োজনে ওই কাজগুলো করেছিল পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ। অনেক জায়গায় বিভিন্ন সামাজিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকেও এরকম উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে হাত ধোয়া বা নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে আমাদের কোনো প্রজেক্ট নেই।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপদ পানি ও হাত ধোয়ার বেসিন বসানোর প্রজেক্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, জিপিএস, এমএনজিপিএস ও পিইডিপি-৪ প্রজেক্ট অনেক বড় প্রজেক্ট। সারাদেশেই এই প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। বিশেষ করে, পিইডিপি-৪ প্রজেক্টের আওতায় এখন পর্যন্ত জেলার প্রায় সাড়ে চারশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও হাত ধোয়ার উন্নত ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। আমরা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে দিচ্ছি। কিন্তু পানি সরবরাহ, বেসিন, ট্যাংকিসহ অন্যান্য জিনিসগুলো সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্ব-স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। এটা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষই করবেন। তবে যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়, আমরা সার্বিক সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

এমএন/এএসএম