গর্তে সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ, মাঠে নামতে অনাগ্রহী চাষিরা
ছবি: মৌসুম শুরু হলেও এখনো প্রস্তুত করা হয়নি অধিকাংশ লবণের মাঠ
* মৌসুম শুরু হলেও মাঠে নেই চাষিরা
* খালি থাকতে পারে ২০ শতাংশ লবণ মাঠ
* উঠছে না উৎপাদন খরচ
* গর্তে মজুত গত বছরের সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ
দেশের চাহিদার শতভাগ লবণ উৎপাদন হয় কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সাগর উপকূলীয় এলাকার মাঠে। কিন্তু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও গত কয়েক বছর ধরে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় উৎপাদন খরচ উঠছে না চাষিদের। ফলে এবার লবণ উৎপাদন মৌসুম শুরু হলেও চাষিদের মাঠে নামার তোড়জোড় নেই। এখনো সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ মাঠের গর্তে পড়ে আছে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলে মাঠে নামবেন না বলে দাবি চাষিদের।
আয়-ব্যয়ে সামঞ্জস্য না হওয়ায় মাঠে নামা না নামার দোলাচলে এবার প্রায় ২০ শতাংশ লবণ মাঠ খালি থাকতে পারে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে কক্সবাজারের ইসলামপুরে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গড়ে তোলা লবণ কারখানাগুলোও স্থবির হয়ে আছে। এখানেও দামের ন্যায্যতার কারণে জমানো লবণ পরিশোধন কম হচ্ছে। এতে লবণ উৎপাদন, পরিশোধন ও ব্যবসায় জড়িত লাখো পরিবার তাদের জীবিকা সংকটে পড়তে পারে। এসব ঘটনা লবণ শিল্পে অশনিসংকেত দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘মাঠে প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করে পেয়েছি ২০০-২৫০ টাকা। ফলে লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ব্যয় ঘাটতি আছে আড়াই লাখ টাকা। লাভের পরিবর্তে লোকসান নিশ্চিত জেনে কীভাবে মাঠে নামবো?’
তবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) লবণ উৎপাদন শাখা সংশ্লিষ্টদের আশা, শিগগিরই লবণ উৎপাদনে মাঠে নামবেন চাষিরা। লবণের ন্যায্যমূল্যও নির্ধারণ হবে।
আরও পড়ুন-
মাঠে অবিক্রীত ৮ লাখ টন লবণ, তবুও আমদানির তোড়জোড়!
লবণ বিতরণের মহৎ উদ্যোগে জল ঢালছে স্বজনপ্রীতি
উপকূলে বাড়ছে লবণাক্ততা কমছে কৃষিজমি
কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী খামারপাড়ার চাষি হারুন রশিদ বলেন, নভেম্বরে শুরু হয় লবণ উৎপাদন মৌসুম। গত বছর এই সময়ে (ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ) লবণ উৎপাদনে ব্যস্ত ছিলেন চাষিরা। আর এ বছর লবণ উৎপাদনতো দূরে থাক, এখনো মাঠ প্রস্তুতও করা হয়নি।
‘মৌসুম শুরুর একমাস পেরিয়ে গেলেও মাঠও শুকানো হয়নি অনেক জায়গায়। খরচ উঠে না আসায় অনেক মাঠ ইজারাও হয়নি। এবার প্রায় ২০ শতাংশ মাঠ চাষের বাইরে থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।’
খুরুশকুল ইউনিয়নের রাস্তারপাড়া গ্রামের লবণচাষি আলী আকবর বলেন, গত বছর দুই একর জমিতে চাষ করে উৎপাদন হয়েছে ১২০০ মণ লবণ। মাঠে প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করে পেয়েছি ২০০-২৫০ টাকা। ফলে লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ব্যয় ঘাটতি আছে আড়াই লাখ টাকা। লাভের পরিবর্তে লোকসান নিশ্চিত জেনে কীভাবে মাঠে নামবো?
ঈদগাঁওয়ের গোমাতলী এলাকার লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী রিদুয়ানুল হক বলেন, মাঠ ইজারা-শ্রমিক-পলিথিনসহ সবকিছুতে খরচ করে অর্ধেক মূল্যে লবণ বিক্রি হচ্ছে দেখে অনেকে গর্তে জমিয়ে রেখেছেন। দাম ভালো পাওয়া গেলে দ্রুত চিংড়ি ঘের শুকিয়ে মাঠে নামার ব্যবস্থা হতো। কিন্তু এবার মৌসুম শুরুর একমাস পেরিয়ে গেলেও মাঠও শুকানো হয়নি অনেক জায়গায়। খরচ উঠে না আসায় অনেক মাঠ ইজারাও হয়নি। এবার প্রায় ২০ শতাংশ মাঠ চাষের বাইরে থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এভাবে আর কয়েক বছর চললে ধীরে ধীরে লবণ চাষ থেকে অনেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলবেন।
শুধু সদর উপজেলা কিংবা ঈদগাঁও নয়, এখনো মাঠে নামেননি টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া ও পেকুয়ার চাষিরাও। সবার দাবি, লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং জমির লিজ মূল্য না কমালে মাঠে নামার সম্ভাবনা নেই।
‘ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাঁশখালীর ছনুয়া এবং কুতুবদিয়ায় নতুন লবণ পাওয়া যাবে। গতবছরের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ মাঠে মজুত রয়েছে। আর লবণ আমদানির বিষয়ে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।’
পেকুয়ার রাজাখালীর লবণ চাষি মুহাম্মদ ইসলাম বলেন, উৎপাদন খরচ উঠছে না দেখে গত দুই বছরের প্রায় দেড় হাজার মণ লবণ এখনো মাঠের গর্তে মজুত। মণপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা পেলেও চাষিরা বাঁচে। কিন্তু গত দুই বছর ধরে মণে টিকছে ২০০-২২০ টাকা। এভাবে হলে সংসার চলবে কীভাবে? লাগাতার লোকসান সইতে পারছি না। তাই মাঠে নামতে ইচ্ছে করছে না।
কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইলের চাষি মুকছুদ আহমদ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দেশীয় লবণ শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশে চাহিদার প্রায় সমান বা কোনো কোনো বছর তার চেয়েও বেশি লবণ উৎপাদন হলেও কেন বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে হবে? আমাদের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য নাই কেন?

মহেশখালীর চাষি জয়নাল আবেদীন বলেন, আর লোকসান সইতে পারছি না আমরা। সরকার ধান-চাল মাঠ পর্যায় থেকে ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করে। কিন্তু লবণের ন্যায্যমূল্য কেন নিশ্চিত করতে পারে না।
বিসিক কক্সবাজার অঞ্চলের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী জানান, শীতকাল ঘিরেই নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত চলে দেশের লবণ উৎপাদন মৌসুম। এসময় কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলীয় অঞ্চলে মাঠ তৈরির পর সমুদ্রের নোনা পানি শুকিয়ে লবণ উৎপাদন করা হয়। মার্চ-এপ্রিল-মে এ তিন মাসের তাপপ্রবাহে লক্ষ্যমাত্রার সিংহভাগ লবণ উত্তোলন করা হয়। বিগত সময়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রায় প্রতিটি এলাকায় লবণ উত্তোলন হতো। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম হয়েছে। কুতুবদিয়া ও বাঁশখালীর ছনুয়ায় স্বল্প পরিমাণ চাষি মাঠে নেমেছেন। সব এলাকা থেকেই ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত থাকার কথাই উঠে আসছে। আমরা সরকারকে অবহিত করেছি- আশা করি ন্যায্যমূল্যে কোনো একটি সমাধান আসবে।
কক্সবাজার লবণচাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সোয়াইবুল ইসলাম সবুজ বলেন, কক্সবাজারে ৪০ হাজারের বেশি লবণচাষি রয়েছেন। পহেলা নভেম্বর থেকে মৌসুম শুরু হলেও এখনো মাঠে নেমেছেন মাত্র কুতুবদিয়া ও ছনুয়ার কিছু চাষি। বাজারে প্রচার পেয়েছে শিল্প লবণ আমদানি হয়েছে। এ কারণে ৩৫-৩৮ হাজার চাষি মাঠে নামেননি। মিল মালিক সিন্ডিকেট, জমির লিজ মূল্য, শ্রমিকের অতিমজুরি এবং দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যসহ বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে সরকার এগিয়ে না এলে এ খাতের ব্যাপক ক্ষতি হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে দরদ দিয়ে সবাই মাঠে নামবে।
এদিকে কক্সবাজার বিসিক কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, লবণ মৌসুম এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। কুতুবদিয়া ও বাঁশখালীর ছনুয়ায় অনেক চাষি মাঠে নেমেছেন। অন্যান্য এলাকাতেও শিগগিরই চাষিরা মাঠে নামবেন বলে আশা করছি। এবারের বর্ষা শেষ হয়েছে দেরিতে- তাই ঘেরও শুকানো হচ্ছে দেরিতে। বর্তমানে চাষিরা মণপ্রতি লবণে ২৪০ টাকা পাচ্ছেন, এটা তাদের হতাশার কারণ। তবে সামনে লবণের দাম বাড়বে বলে আমরা আশাবাদী। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিসিক চেয়ারম্যান কক্সবাজার সফর করে লবণ মাঠ পরিদর্শন এবং চাষিদের সঙ্গে কথা বলে উৎসাহিত করেছেন।
জাফর ইকবাল আরও জানান, যেসব এলাকায় চাষিরা এখনো মাঠে নামেননি, তারা দ্রুত মাঠে নামবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাঁশখালীর ছনুয়া এবং কুতুবদিয়ায় নতুন লবণ পাওয়া যাবে। গতবছরের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ মাঠে মজুত রয়েছে। আর লবণ আমদানির বিষয়ে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ১১ নভেম্বর স্থানীয় লবণ মিল মালিকদের সঙ্গে বার্ষিক পর্যালোচনা সভায় লবণের মজুত, ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, লবণ মিল মালিক-প্রান্তিক চাষিদের সমস্যা ও লবণ শিল্পের সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনা হয়।
সভা শেষে শিল্প সচিব ওবায়দুর রহমান বলেন, শিল্প লবণের আড়ালে কোনো অজুহাতে খাবারের লবণ আমদানি করতে দেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংশ্লিষ্টদের উত্থাপিত প্রস্তাবনা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পর্যালোচনা করে লবণের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে ব্যবস্থা এবং কক্সবাজারে জমি পেলে লবণ সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা হবে।
প্রসঙ্গত, গত বছর ৬৯ হাজার একর জমিতে ৪১ হাজারের বেশি চাষি লবণ উৎপাদন করেন। লবণের চাহিদা ধরা ছিল ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৬৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪ লাখ ৩৮ মেট্রিক টন লবণ। এর আগের বছর মজুত থাকা লবণে শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ছিল। চলতি বছরও লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন।
এফএ/জেআইএম