ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ভোটের আগে আইনি জালে মান্না: কাকতালীয় নাকি টার্গেট

নিজস্ব প্রতিবেদক | বগুড়া | প্রকাশিত: ০১:১৭ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫

ভোটের ঠিক আগমুহূর্তে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জালিয়াতি ও খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিলের চেষ্টার অভিযোগে মামলা, ব্যাংকের কল ব্যাক নোটিশ এবং ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার আবেদন খারিজ- এই তিন ঘটনা একসঙ্গে সামনে আসায় তার নির্বাচনি এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান ঋণসংক্রান্ত বিষয়গুলো এতদিন আলোচনার বাইরে থাকলেও নির্বাচনের প্রাক্কালে কেন এসব আইনি পদক্ষেপ একযোগে সক্রিয় হলো, এর পেছনে কী থাকতে পারে- সেই কৌতূহলই এখন সাধারণ ভোটারদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

তারা বলছেন, মাহমুদুর রহমান মান্নার ঋণখেলাপি হওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু ভোটের ঠিক আগমুহূর্তে যে মামলাটি হলো, সেটি শুধু ঋণসংক্রান্ত নয়। অভিযোগটি সরাসরি স্বাক্ষর জালিয়াতি, ভুয়া বোর্ড রেজুলেশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিভ্রান্ত করার মতো গুরুতর অপরাধের। যা তাদের মনে নানা সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে।

বগুড়ার শিবগঞ্জের কিচক বাজারে অবস্থিত আফাকু কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড। কাগজে কলমে এটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। অথচ এখান থেকেই ৩৮ কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি হয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এই খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিলের চেষ্টাকেই কেন্দ্র করে মামলা।

মামলার অভিযোগ বলছে, আফাকু কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম নাজমুল কাদির শাহজাহান চৌধুরী ও তার স্ত্রী ইসমত আরা লাইজু গত বছরের ১৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। দুজনই বর্তমানে পলাতক। অথচ তাদের অনুপস্থিতিতেই ১ ডিসেম্বর একটি বোর্ড সভা দেখানো হয়। ওই সভার রেজুলেশনে ৩৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ এই রেজুলেশনে পলাতক দম্পতির স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই ভুয়া কাগজপত্র বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকে জমা দিয়ে পুনঃতফশিলের অনুমোদন আদায়ের চেষ্টা করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, যদি সবকিছু এত স্পষ্টভাবে ভুয়া হয়, তাহলে এই কাগজপত্র কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত পৌঁছালো? কারা চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করলো? মামলায় ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে যা ইঙ্গিত দেয়- বিষয়টি কোনো ছোটখাটো কারসাজি নয়।

মামলার বাদী মিল্লাত হোসেনের দাবি অনুযায়ী, এর আগেই আফাকু কোল্ড স্টোরেজ বিক্রির একটি চুক্তি হয়। ২৫ কোটি টাকায় সম্পত্তি বিক্রির কথা, যার মধ্যে ১০ কোটি টাকা পরিশোধও করা হয়। বাকি ১৫ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই চুক্তির পরই মূল খেলাটা ঘুরে যায়। একদিকে ব্যাংক থেকে কলব্যাক নোটিশ ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি। অন্যদিকে ঠিক সেই সময় ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করে পুনঃতফশিলের দৌড়ঝাঁপ। এই দুই লাইনের মাঝেই তৈরি হয় ফৌজদারি মামলা।

এর পরের ঘটনাপ্রবাহ আরও তাৎপর্যপূর্ণ। ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে করা মান্নার রিট খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। ফলাফল একটাই তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপক্ষও সেটাই স্পষ্ট করে জানায়। অর্থাৎ একই সময়ে তিনটি চাপ। এক. ফৌজদারি মামলা, দুই. ব্যাংকের আইনি নোটিশ, তিন. নির্বাচনে অযোগ্যতা। সবকিছু মিলিয়ে মান্না কার্যত কোণঠাসা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক আমীর মাহমুদের মতে, এখানে প্রশ্ন শুধু মান্না নির্দোষ কি না, তা নয়। প্রশ্ন হলো, এই মামলা যদি কয়েক মাস আগেও হতো, তাহলে কি এর রাজনৈতিক অভিঘাত এতটা হতো? পলাতক অংশীদারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ঋণখেলাপিও নতুন নয়। কিন্তু ভোটের ঠিক আগে সব আইনি গতি একসঙ্গে সক্রিয় হওয়াকে অনেকেই কাকতালীয় মানতে গেলে কিছুটা অবাক হতে হয়।

আরেকটি দিকও চোখে পড়ছে। মামলায় যিনি সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারেন, তিনি হলেন সেই অংশীদাররা, যারা বিদেশে পলাতক। সম্পত্তি বিক্রির চুক্তি, ঋণ পুনঃতফশিলের চেষ্টা, দায় ঠেলে দেওয়া সবকিছুর শেষে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী একজনই মুখ্য অভিযুক্ত হয়ে দাঁড়ান।

দুদক বলছে, তারা আদালতের নির্দেশ পেয়েছে এবং ঢাকায় নথিপত্র পাঠানো হয়েছে। তদন্ত শুরু হলে বোঝা যাবে, এটি শুধুই একটি আর্থিক জালিয়াতির মামলা, নাকি রাজনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার গোপন যোগসাজশের আরেকটি উদাহরণ।

শিবগঞ্জের বাসিন্দা আব্দুর মতিন বলেন, ভোটের মাঠে নামার আগেই মান্না এখন আইনি জালে বন্দি। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে তিনি কি অপরাধের ভিকটিম, নাকি সময় বেছে নেওয়া এক পরিকল্পিত টার্গেট?

বাদীপক্ষের আইনজীবী আবদুল ওহাব বলেন, ব্যাংকিং নীতিমালা লঙ্ঘন করে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে পুনঃতফশিল আদায়ের চেষ্টা হয়েছে। এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম নয়, বরং রাষ্ট্রীয় আর্থিক ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা।

মামলাটি আমলে নিয়ে আদালত দুদককে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। দুদক বগুড়া সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাহফুজ ইকবাল বলেন, আদালতের আদেশের কপি হাতে পেয়েছি। নথিপত্র ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক যাচাই শেষে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এদিকে ইসলামী ব্যাংক বলছে, এখানে রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রশ্ন নয়, বিষয়টি পুরোপুরি আর্থিক শৃঙ্খলার।

ইসলামী ব্যাংক বগুড়া বড়গোলা শাখার প্রধান তৌহিদ রেজা বলেন, আফাকু কোল্ড স্টোরেজ দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত কিস্তি ও মুনাফা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে কোনো আন্তরিকতা দেখা যায়নি। সে কারণেই কল ব্যাক নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কারণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না হলে ব্যাংক আইনি পথে যেতে বাধ্য।

এর মধ্যেই ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে করা মাহমুদুর রহমান মান্নার রিট খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ঋণখেলাপি হওয়ায় তার রিট গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে আইন অনুযায়ী তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

অন্যদিকে মাহমুদুর রহমান মান্না অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, আমি কোনো স্বাক্ষর জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো একতরফা ও সময় নির্বাচন করে সাজানো। ঋণসংক্রান্ত বিষয় আদালতে নিষ্পত্তির পর্যায়ে ছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে ফৌজদারি মামলার নাটক তৈরি করা হলো। তার দাবি, পলাতক অংশীদারদের দায় তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, যারা বিদেশে পালিয়ে গেছে, তাদের দায় এড়িয়ে গিয়ে আমাকে একমাত্র টার্গেট করা হয়েছে। আমি আইনের ওপর আস্থা রাখি এবং এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে আইনগত লড়াই চালাবো। আইনজীবী সূত্র বলছে, হাইকোর্টের রিট খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।

স্থানীয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনটি দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির প্রভাবশালী আসন হিসেবে পরিচিত। আসন্ন নির্বাচনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এই আসনে প্রার্থী হলে তিনি মূলত বিএনপির ছেড়ে দেওয়া আসন থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

এর আগে বিএনপি এই আসনে দলটির প্রভাবশালী নেতা মীর শাহে আলমকে মনোনয়ন দেয়। সংগঠনের ভেতরে শক্ত অবস্থান, দীর্ঘদিনের মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যক্তিগত ভোটব্যাংকের কারণে তিনি এলাকায় সুপরিচিত ও প্রভাবশালী প্রার্থী হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে জামায়াতও এই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে। জামায়াতের প্রার্থী অধ্যক্ষ মাওলানা শাহাদুজ্জামান এ আসনের সাবেক এমপি। এছাড়াও তিনি স্থানীয়ভাবে সংগঠিত নেতা হিসেবে পরিচিত। তার নিজস্ব অনুসারী ও ভোটব্যাংক রয়েছে। ফলে নির্বাচনের মাঠে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি সমীকরণ আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল।

এই অবস্থায় মাহমুদুর রহমান মান্নার প্রার্থী হওয়া ভোটের হিসাব নতুন করে জটিল করে তুলছিল বলে মনে করছেন সে এলাকার ভোটাররা। তাদের মতে, মান্না নির্বাচনে থাকলে বিএনপি ও জামায়াত দুই পক্ষেরই ভোটে বিভাজন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিশেষ করে নিরপেক্ষ ও শহরকেন্দ্রিক ভোটারদের একটি অংশ মান্নার দিকে ঝুঁকতে পারত।

এদিকে আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে চেনাজানা মানুষের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছেন মান্না। শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর তোপখানা রোডে নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মান্না এ কথা জানান। এ সময় সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ২০০৭–০৮ সালের দিকে নিজ এলাকায় ঋণ নিয়ে একটি হিমাগার করেছিলেন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমস্যা দেখা দেওয়ার পর তিনি জেলে যান। সেসময় তার ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন ইউনিয়ন পর্যায়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি গ্রেফতারের পর ওই ব্যবসা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার ব্যবসায়িক অংশীদার এর এমডি হয়ে যান। ১০-১২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, যা এখন ৩৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ৫ আগস্টের পর ওই এমডির নামে হত্যা মামলা, মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হয়েছে। এজন্য তিনি স্ত্রীসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। ঋণখেলাপি থেকে বাঁচতে হলে ওই এমডিকে আদালতে হাজির করতে হবে। তবে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন, এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

আদালতে গেলে তার পক্ষে আদেশ এসেছে, যাতে তার নামটি খেলাপির তালিকায় না থাকে। কিন্তু দুপুরে দেওয়া ওই আদেশ সন্ধ্যায় স্থগিত করা হয়েছে। একটি শ্রেণি সেটি আটকে দিয়েছে, যাতে তিনি নির্বাচন করতে না পারেন। বগুড়ায় বিএনপির স্থানীয় সভাপতি একজন সংসদ সদস্য প্রার্থী। তিনি তার প্রভাব দলগতভাবে ব্যবহার করছেন। দলের একটি অংশ আদালতেও সেই প্রভাব ব্যবহার করছে। অভ্যুত্থানের পর বিচারব্যবস্থা এখনো প্রভাবিত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, তিনি আদালতের কাছে কিছুটা সময় চেয়েছেন। এর মধ্যে নির্বাচনী মনোনয়ন ফরমও জমা দিতে হবে। তাই তিনি চাচ্ছেন, সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে ঋণখেলাপিদের তথ্য সংরক্ষণ) যাতে স্থগিত করা হয়। ঋণখেলাপির তালিকা থেকে তার নাম যেন বাদ রাখা হয়।

তিনি বলেন, যারা তাকে জানেন, ভালোবাসেন, সেই বিশ্বাস থেকে কেউ যদি এই টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন, তাহলে তিনি নির্বাচন করতে চান।

এফএ/এএসএম