প্রতিবন্ধী বদরের ঘাড়ে ঋণের বোঝা
‘বাবারে আর তো পারি না, খোঁড়া মানুষ, চলতে-ফিরতে পারি না, এক বেলা আধা পেট তো আরেক বেলা অনাহারে, এর উপর ১০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা তো আর বইতে পাড়ি না।’ লাঠিতে ভর করে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন জয়পুরহাট শহরের খঞ্জনপুর এলাকার ষাট বছরের বৃদ্ধ প্রতিবন্ধী বদর উদ্দীন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, জয়পুরহাট জেলা শহরের খঞ্জনপুর এলাকার সাখিদার পাড়া মহল্লার খঞ্জনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে নিজ বসতবাড়িতে ১ ছেলে, ১ মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই চলছিল বদর উদ্দীনের সংসার।
বৃদ্ধ বদর উদ্দীন এক সময় একজন প্রতিষ্ঠিত মৌসুমী ব্যবসায়ী ছিলেন। ধান, পাট, সরিষা, চাল-ডালসহ নানা মৌসুমী ফসলের বড় আড়ৎদার হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তার ব্যবসায়িক সুখ্যাতি।
কোনো অভাবী মানুষকে খালি হাতে ফিরতে দিতেন না বলে তার সুনাম এখনো মানুষের মুখে মুখে। সেই সমৃদ্ধশালী বদর উদ্দীনের সুখের ঘরে দুঃখের আগুন জ্বলে শুধু চড়া সুদে ব্যাংক ঋণের কারণে। এক সময়ের দানশীল বদর উদ্দীনের ঋণের কারণে আজ জীবন চলে খেয়ে না খেয়ে।
প্রতিবেশী সেলুন ব্যবসায়ী শাহজাহান আলী, মুদি ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেনসহ এলাকাবাসী এসব তথ্য জানিয়ে আরও বলেন, এক সময়ে অর্থ-বিত্তবান ও হাসি-সুখি বদর উদ্দীন শুধু ঋণের কারণে আজ পথে বসেছেন।
বদর উদ্দীন জানান, বেশি লেখাপড়া না জানলেও তিনি তরুণ বয়স থেকে ব্যবসা বুঝতেন, আর এ কারণে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবসার উন্নতি হয়। এ অবস্থার মধ্যে প্রায় ১০ বছর আগে টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশকিছুদিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। টাইফয়েট রোগ থেকে বাঁচলেও ডান পা চিরদিনের জন্য অবশ হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয় তাকে।
এ সময় অসুস্থতার কারণে একদিকে চিকিৎসা খরচ অন্যদিকে ব্যবসা বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবে তিনি লোকসান গুণতে থাকেন। সুস্থ হলেও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নিয়ে লোকসান কাটিয়ে আবারও ব্যবসায়িক উন্নতি লাভের পাশাপাশি একটু স্বচ্ছলতার আশায় তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের কথা ভাবতে থাকেন।
বদর উদ্দীন কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, সব নিয়ম মেনে তিনি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের জয়পুরহাট শাখা থেকে গত ২০১২ সালের ৮ অক্টোবর ৪ লাখ টাকার ঋণ গ্রহণ করেন। সুদাসলে সেই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯২৬ টাকা।
গত ২০১৩ সালের ৪ অক্টোবর পরিশোধের কথা থাকলেও বিভিন্ন হাট-বাজার থেকে কেনা প্রায় ৫ লাখ টাকার শতশত মন পাট বাকিতে বিক্রি করেন খুলনার ফুলতলার আফিল জুট মিলস-এ ।
তিনি বারবার ওই জুট মিলে যোগাযোগ করে একটি টাকাও পাননি, উপরন্তু পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়ে একদিকে বাড়তি টাকা খরচ হয় অন্যদিকে শারীরিকভাবে অসমর্থ প্রতিবন্ধী বারবার জয়পুরহাট থেকে সুদূর খুলনায় যাতায়াত করতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
জুট মিলের এই বিপুল পরিমাণ বকেয়া পাওনা ও লোকসানের বোঝা কমাতে এবং বদর উদ্দীন নতুন উদ্যোমে ব্যবসা দাঁড় করাতে ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারিতে আবারও ঋণ নেন। এবার তিনি ব্র্যাক ব্যাংকের জয়পুরহাট শাখা থেকে ৯ লাখ টাকার ঋণ গ্রহণ করেন।
কিস্তিপ্রতি ৪০ হাজার ২০০ টাকা করে ৩০ মাস মেয়াদি ব্রাক ব্যাংকের ওই ঋণ গ্রহণ করে মাছ চাষ করতে তিনি জলাশয় ইজারা নেন। কিন্তু মাছ চাষেও লোকসানে পড়েন তিনি।
সুদসহ প্রায় অর্ধেকের বেশি টাকা নিয়মিত শোধ করার পর ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসানের কারণে ওই ব্যাংকের অবশিষ্ট ৫ লাখ ৯ হাজার ৪৮০ টাকাও পরিশোধ করতে তিনি অপারগ হন।
বদর উদ্দীনের অসুস্থ স্ত্রী শহিদা বেগম, প্রতিবেশী অ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ দিলিপ কুমার সরকারসহ এলাকাবাসী জানান, বদর উদ্দীনের অসুস্থতা, খুলনার জুটমিলটির কাছ থেকে বাকি বিক্রি করা পাটের পাওনা টাকা তুলতে ব্যর্থ হওয়া ছাড়াও মাছ চাষে বড় অঙ্কে লোকসানের কারণেই একদিকে পথে বসেছেন অন্যদিকে সুদ-আসলসহ ওই দুটি ব্যাংকের ১০ লাখ টাকারও বেশি ঋণ পরিশোধে অপারগ হন তিনি।
এদিকে দুটি ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পাওনা আদায়ে ব্যাংক দুটি আইনানুগ ব্যাবস্থা গ্রহণ করে যথাযথভাবেই। প্রথমে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক সুদ-আসলে প্রায় ৫ লাখ টাকা আদায়ের জন্য বদর উদ্দীনকে গত ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি চূড়ান্ত নোটিশ দেয়াসহ আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহণ করে বলে জানান ব্যাংকটির আইনজীবী হাফিজার রহমান।
এ ছাড়া ব্র্যাক ব্যাংক সুদ-আসলে ৫ লাখ ৯ হাজার ৪৮০ টাকা আদায়ের জন্য ব্যাংকটির জয়পুরহাট শাখার অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার এস এম শামছুল আলম বাদী হয়ে ২০১৬ সালের ১৫ জুন অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল আদালতে মামলা দায়ের করেন বলে জানান ব্যাংকটির আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মামুন।
সব হারানো বদর উদ্দীন ওই দুটি ব্যাংকের মোট ১০ লাখ টাকারও বেশি ঋণের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন তা জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানান, ‘ছোট যমুনার পাড়ে ৩ বিঘা জমি ছিল, যা বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলাম, যা নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে এই জোড়াতালি দেয়া বেড়ার তৈরি বাড়ি। যা নিলামে নিলে ঋণ তো দূরের কথা সুদের ১০০ ভাগের ২ ভাগও শোধ হবে না।
২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি জয়পুরহাট সমাজসেবা অধিদফতরে শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে নিবন্ধিত হলেও এখনো তার ভাগ্যে জোটেনি প্রতিবন্ধী ভাতা। এমন ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, একটা ছেলে আছে, চা-পানের দোকান করে কোনো রকমে নিজে চলতে পারে।
এ অবস্থায় এতোগুলো ঋণের টাকা পরিশোধ করার মতো তার কোনো উপায় নেই বলে এ ঋণ মওকুফের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক দুটির কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন বদর উদ্দীন ও তার এলাকাবাসী।
রাশেদুজ্জামান/জেডএ/জেআইএম