ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

বাংলাদেশের জলসীমায় বিদেশি জলদস্যুর উৎপাত : মাছের আকাল

প্রকাশিত: ১২:০২ পিএম, ২৫ জুন ২০১৫

ইলিশের দেশে ইলিশের আকাল। বিভিন্ন নদীতে মাছ না থাকায়, মাছের চরম আকাল দেখা দিয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রধান মাছের আড়ত পাড়েরহাট মৎস্যবন্দর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে। জেলেরা বলছে বাংলাদেশ জলসীমায় ভারতীয় জেলে। তার উপর জলদস্যুদের উৎপাত বৃদ্ধি।

উপকূলীয় হাট-বাজার ঘুরে দেখা যায়, ইলিশ না মিললেও ট্রাকে ট্রাকে এলসির রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, চাষের পাঙ্গাস, কৈ এবং কোল্ড স্টোরেজের কিছু সামুদ্রিক মাছ। বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত মাছ এই এলাকার মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ করলেও সাগর থেকে বিগত এক মাস ধরে আসছে না কোনো মাছ।

ভাসমান মাছ ব্যবসায়ী মো. ইকবাল ও আড়তদার মো. সিদ্দিক জানান, সকালের দিকে অল্প কিছু ইলিশ আসলেও তা সাধারণ ক্রেতাদের হাতে পড়ার আগেই ধনীরা কিনে ফেলে। বছরের ১২ মাসের মধ্যে সব সময়ই কম বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। যার দরুণ তাকে রূপালী মাছ বলা হয়ে থাকে।

আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন এ চার মাসের মধ্যে বিশেষ করে আবার আষাঢ়-শ্রাবণ এ দু`মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। এই সময়ে সাগরে থাকে জেলেদের ইলিশ ধরার মহোৎসব। কিন্তু এবার উৎসব উপভোগ করতে পারছেনা পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলেরা। একদিকে জলদস্যুদের মুক্তিপণ, অন্য দিকে রাতে বাংলাদেশ জলসীমায় ঢুকে পড়ছে ভারতীয় জেলেরা।

এছাড়াও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার অক্টোবরে মাসের ১১ দিন জেলেদের মাছ ধরার উপর বিধি নির্দেশ আরোপ করে। তারপর সেগুলো বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ করে। এই সময়ে সাগর বা নদ-নদীতে ইলিশের সংখ্যা বাড়ে এবং সেগুলোর আকার থাকে বেশ বড়।

উপকূলীয় জেলেরা জানান, অতীতে যেভাবে জেলেরা সাগরে মাছ শিকার করতে পারতো এখন আর তা সম্ভব হয় না। তাদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেতে হয় মৎস্য শিকারে। এছাড়া জলদস্যুদের মুক্তিপণ আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নানা ঝুট ঝামেলা তো আছেই।

তারা আরো জানান, আদি পেশা মাছ ধরা হওয়ায় সংসার চালানো এবং ঈদে ছেলে-মেয়েদের আবদারের কথা ভেবে সব প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেও সাগরে যেতে হয়। জলদস্যুদের উৎপাত বন্ধে কোস্টগার্ড, র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনী জলদস্যুর উৎপাত বন্ধে নানা তৎপরতা অব্যাহত রাখছে। এমনকি বন্দুকযুদ্ধে অনেক দস্যু নিহতের ঘটনাও ঘটছে। তারপরও জেলেদের ওপর দস্যুদের অত্যাচার, মুক্তিপণ ঠেকানো যাচ্ছেনা। জলদস্যুদেরও রয়েছে স্থানীয় দালাল। এছাড়াও তারা কোস্টগার্ড, র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীকে ঠেকাতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে বলে জানা গেছে।



উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের জেলে মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েকশ মাছ ধরার ট্রলার থাকলেও ইলিশ মৌসুম শুরুর প্রথম সপ্তাহে (বর্তমানে) সাড়ে তিনশ ট্রলার সাগরে রয়েছে।

তিনি আরো জানান, এক দিকে নিম্ন চাপে উত্তাল সাগর, অন্যদিকে বাংলাদেশি জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের অত্যাধুনিক অস্ত্র আর রাডার। যার ফলে সাগরে যেসব জায়গায় ইলিশ বেশি, সেসব জায়গা থেকে তারা মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। আর বাংলাদেশি জেলেদের বোর্ডে কোনো অস্ত্র না থাকায় ওই জেলেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইলিশ শিকার করা সম্ভব হয়না। যার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের হাট বাজারে ইলিশের দেখা মিলছেনা।

তার ওপর রয়েছে জলদস্যুদের অমানবিক অত্যাচার। তাদের নিময় মেনে টোকেন না নিয়ে সাগরে গেলে জেলেদের আটকে রেখে এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। মুক্তিপণের টাকা না দিলে চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। অনেক জেলেরা সব সম্পদ বিক্রি করে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ফেরত আসে।  তাদের বলে দেওয়া হয় এ ঘটনা কেউ জানলে পরবর্তীতে তাদের মরদেহ ফেলে দেওয়া হবে সাগরে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তবুও সাগরে যায় জেলেরা।

এসব বোর্ডে ১৫/২০ জন জেলের এক সপ্তাহের বাজার, ইঞ্জিনের তেলসহ ট্রিপ দিতে যেখানে খরচ হয় এক লাখ থেকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা, সেখানে তারা মাছ নিয়ে আসে কখনও কখনও মাত্র ১০ হাজার টাকার। লাভের আশায় অধিক মুনাফায় দাদন অথবা বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেয় জেলেরা। অবশেষে তাদের লাভ তো দুরের কথা, গুণতে হয় লোকসান। এর ফলে একদিকে এ এলাকার মানুষ আমিষের অভাব পূরণকারী খাদ্য উপাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে মাছের উপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন।

পাড়েরহাট মৎস্য বন্দরে দেখা গেছে, মাছ শূন্য আড়ত। সেখানকার আড়তদার, শ্রমিক ও মৎস্য পেশার উপর নির্ভরশীল লোকজন অলস সময় কাটাচ্ছেন।



বর্তমানে পিরোজপুর শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের মাছের চাহিদা পূরণের একমাত্র ভরসা হাইব্রিড পাঙ্গাস ও কৈ মাছ। এসব মাছ কিনতেও দিতে হয় চড়া দাম। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি পাঙ্গাস বিক্রি হয় ৮০/১০০ টাকায় এবং কৈ মাছ প্রতি কেজি ২০০ টাকায়।

সমুদ্র থেকে আহরিত অধিকাংশ মাছ পাড়েরহাট মৎস্য বন্দরে আনা হলেও, সেখানে বিগত এক মাস ধরে পাঙ্গাস, কৈ এবং কোল্ড স্টোরেজের কিছু সামুদ্রিক মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ দেখা যায়নি। এমনকি এখানকার বাজারগুলোতে দেশীয় প্রজাতির কোনো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।

অন্যদিকে, নদী তীরবর্তী এলাকাগুলে ঘুরে জানা যায়, স্থানীয় জেলেরা অবৈধ কারেন্ট ও বান্দা জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছের পোনা ধ্বংস করছেন। এর ফলে নদীতে মাছের চরম আকাল দেখা দিয়েছে। মৎস্য বিভাগ বিভিন্ন সময় এসব জাল নষ্ট করলেও কমছে না অবৈধভাবে নদী থেকে মাছ আহরণ।

অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ থাকার সময়ে জেলেদের পুনর্বাসনের জন্য মার্চ থেকে চার মাস পর্যন্ত ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হয়ে থাকে।

জাটকা শিকার থেকে বিরত থাকা কয়েকজন জেলে জানান, মার্চ মাসে তালিকাভুক্ত জেলেদের ভিজিএফের চাল দেওয়ার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা তালিকা তৈরিতে দেরি করার জুন মাসেও চাল বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। এতে জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ২ হাজার ৩০০ জেলের মধ্যে ৮৭০ জন জেলে মার্চ মাসের ভিজিএফের চাল এখনো পাননি।

এ বিষয়ে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা শামসুল হক জানান, জনপ্রতিনিধিরা তালিকা তৈরি করতে দেরি করায় যথাসময়ে চাল বিতরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ থাকার সময়ে জেলেদের পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আহসান হাবিব বলেন, জেলেদের চালের ডিও চেয়ারম্যানদের দেওয়া হয়েছে। অনেকে চাল বিতরণ করেছেন। তবে জেলেদের তালিকা করতে দেরি হওয়ায় কয়েকটি ইউনিয়নে চাল বিতরণ এখনো করা হয়নি।

জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অনিল চন্দ্র দাস জানান, উপজেলায় ১৭৫৫ জন জেলের মধ্যে জুন মাসের চাল বিতরণ করা হয়নি। এছাড়াও পিরোজপুর সদর উপজেলায় ১৩৮০ জন, নেছারাবাদ (স্বরুপকাঠী) উপজেলায় ১৫৪৭ জন, কাউখালী উপজেলায় ৭২৮ জন জেলের মধ্যে জুন মাসের চাল বিতরণ করা হয়নি। তবে বিতরণ কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান এসব উপজেলার মৎস্য কর্মকতারা।

তবে এর বাইরেও নাজিরপুরে ৯২১ জন এবং জিয়ানগরে আরো ৯২০ জন পায়নি পুনর্বাসন প্রকল্পের ভিজিএফের চাল। সব মিলিয়ে উপকূলীয় জেলেরা এ মুহূর্তে যাপন করছেন মানবেতর জীবন।

এআরএ/আরআই/এসআরজে