‘তারা বেতন নেন কিন্তু সেবা দিতে আসেন না’
পার্বত্য খাগড়াছড়ির সীমান্তঘেঁষা দুর্গম জনপদ বড়নাল। সেখানেই পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবার একমাত্র প্রতিষ্ঠান বড়নাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। যেখানে সাতদিন ২৪ ঘণ্টা সেবা দেয়ার কথা সেখানে সপ্তাহে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য তালা খোলা হয়। তবে সেবা নামের সোনার হরিণ অধরাই রয়ে গেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাইরে থেকে তালা লাগানো বড়নাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের একতলা ভবনটি। শেষ কবে ভবনটি খোলা হয়েছিল তাও জানাতে পারেননি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
বড়নাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে একজন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, একজন নিরাপত্তা প্রহরী ও একজন আয়া থাকার কথা থাকলেও কর্মরত একজন নিরাপত্তা প্রহরী। উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ও ফার্মাসিস্টের পদটি দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য।
অন্যদিকে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা প্রেষণে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় কর্মরত। দিনের পর দিন জনবল সঙ্কট আর প্রেষণজ্বরে ভুগছে বড়নাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।

এখানে প্রতিদিনই দুর্গম পাহাড়ি জনপদের নারীরা সেবা নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন- এমন অভিযোগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। বড়নাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর বলেন, দিনের পর দিন সংশ্লিষ্টদের অনুপস্থিতি আর গাফিলতির কারণে সেবাবঞ্চিত হচ্ছে এ জনপদের মানুষ। এ কারণে সাধারণ মানুষকে সেবা পেতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরে যেতে হচ্ছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, বেলছড়ি ইউনিয়ন থেকে মাঝে মাঝে একজন আসেন। কয়েক ঘণ্টা থেকে আবার চলে যান। তিনি বলেন, ভিজিটরের এখানে ২৪ ঘণ্টা থেকে মানুষের সেবা দেয়ার কথা থাকলেও তারা তা করেন না। ফলে সাধারণ মানুষ সেবা না পেয়ে প্রতিদিনই ফিরে যাচ্ছে। তারা চাকরি করেন, বেতন নেন, কিন্তু সেবা দিতে আসেন না।
একই অবস্থা উপজেলার গোমতি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রেরও। দোতলা নান্দনিক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকার পরও দায়িত্বপ্রাপ্তরা না আসায় মাসের বেশির ভাগ সময়ই তালাবদ্ধ থাকে কেন্দ্রটি। ভবনটির দরজায় তালা লাগানো থাকলেও গরু-ছাগলের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে সামনের প্রশস্ত মাঠটি। এখানে একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিওভি) সপ্তাহে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য আসেন বলে জানান স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মো. ওসমান গনি।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে ২৪ ঘণ্টা স্বাভাবিক প্রসব সেবা প্রদান করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা কেন্দ্রে অবস্থান না করায় সাধারণ জনগণ সে সেবা থেকে বঞ্চিত। এতে মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। অবিলম্বে প্রেষণে থাকা পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকাদের প্রেষণাদেশ বাতিল করে সেবা নিশ্চিত করার দাবি এলাকাবাসীর।

এদিকে মাঠ পর্যায়ে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রেষণে থাকা পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে পদায়নের জন্য চিঠি দিয়েছেন মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নিটোল মনি চাকমা। গত ৭ মার্চ প্রেরিতপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, কেন্দ্রগুলোতে ভিজিটররা না থাকায় গর্ভবতী সেবা, প্রসব সেবা এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
শুধু বড়নাল বা গোমতিই নয় জনবল সংকট ও প্রেষণজ্বরে মুখ থুবড়ে পড়েছে পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ির পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম। জেলার আট উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের অনুকূলে ১০ জন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের অনুমোদিত পদ থাকলেও কর্মরত পাঁচজন।
অন্যদিকে প্রতি উপজেলায় একজন করে মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও শুধু মহালছড়ি উপজেলায় একজন কর্মরত। যিনি খাগড়াছড়ি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে প্রেষণে সংযুক্ত। অন্যদিকে মাটিরাঙ্গা ও পানছড়িতে দুজন থাকলেও তাদের দুজনই উন্নততর প্রশিক্ষণে তিন বছরের জন্য ঢাকায়। ১৪ জন ফার্মাসিস্ট থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন দুজন।
জনবলের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, জনবল চেয়ে অধিদফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে। যেখানে পদ নেই সেখানে পদ সৃজন করে এবং শূন্যপদগুলো পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে চলমান সঙ্কট কেটে যাবে।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/আরএআর/এমএস