টকটকে লাল শিমুলবাগে লেগেছে বাসন্তী হাওয়া
টকটকে লাল শিমুল ফুটেছে বাগানজুড়ে। সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্তিম রঙে গাছে গাছে ফুটেছে হাজারো শিমুল ফুল। এটিই দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান যার অবস্থান সুনামগঞ্জের তাহিরপুর মানিগাঁওয়ের শিমুলবাগে।
প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে টাঙ্গুয়ার হাওরের সুবিশাল স্বচ্ছ জলরাশী, ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট লেক, মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা স্বচ্ছ নীলজল খ্যাত নীলাদ্রী বীরউত্তম সিরাজ লেক, স্বচ্ছজল বা ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ওয়াটার খ্যাতি পাওয়া রূপবতী জাদুকাঁটা নদী আর মেঘালয়ের ঠিক মাঝখানে বারাম নদীর তীরে ধু ধু বালুচরে একজন প্রকৃতিপ্রেমী জয়নাল আবেদীন রেখে গেছেন তার অনন্য কীর্তি দেশের সর্ববৃহৎ সুবিশাল শিমুল বাগান। ফাগুনের অরুণ আলোয় ফুটে ওঠা শিমুল বাগানের এই টুকটুকে লাল ফুলগুলো দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন শত শত পর্যটক।
দুর্গম হাওরের সবুজ বিপ্লবের এই নায়ক জেলার বিচ্ছিন্ন জনপদ বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে পরিবারের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন ১২ বছর বয়স থেকে। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন উদ্যমী বৃক্ষপ্রেমী। গাছপালার প্রতি ছিল তার অপরিসীম মমতা। গাছ লাগাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।

এমনি করে কালের সাক্ষী হতে প্রকৃতির বুকে একটু অলংকার জুড়ে দিতে প্রয়াত জয়নাল আবেদীন দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগানটি গড়ে তোলেন মেঘালয়ের পাদদেশ ও অপূর্ব জাদুকাঁটা নদীর মধ্যস্থলের বিস্তীর্ণ এলাকায়।
গাছ লাগানো ও পরিচর্যার পুরনো নেশাই তাকে বাগান করতে প্রভাবিত করে। বাগানটির নাম ‘শিমুলবাগ’। বিস্তীর্ণ পরিসরে এত বড় শিমুল বাগান দেশের আর কোথাও নেই। উত্তর বড় বদল ইউনিয়নের সুদৃশ্য বারাম নদীর তীর ঘেঁষেই মানিগাঁও গ্রাম।
এ গ্রামে জয়নাল আবেদীনের নিজস্ব আড়াই হাজার শতক জায়গা একেবারেই অনাবাদী ছিল। পলির পরিবর্তে এখানে উজান থেকে ভেসে আসে বালি। এই ধু ধু বালিয়াড়িতে কীভাবে সবুজের প্রলেপ এঁকে দেওয়া যায় তারই এক অনন্য উদাহরণ এটি।
১৯৯৮ সালে এই জায়গাটির পাশে দুটো পরিণত শিমুল গাছ দেখে তিনি এখানে শিমুল বাগান করার পরিকল্পনা হাতে নেন! শেষমেশ ২০০২ সালের দিকে শিমুল বাগান গড়ে তোলেন। সমান ১৪ ফুট দূরত্ব রেখে ২৪০০ শতক জায়গায় লাগিয়ে দিলেন ৩ হাজার শিমুলের চারা।
১৯ বছরে গাছগুলো বড় হয়ে যৌবনে পা রেখেছে। শিমুল বাগানের কাছেই আছে সুদৃশ্য বারেক টিলা। এই টিলায় বসে জাদুকাটা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় খুব সহজেই। ফাগুনের অরুণ আলোয় ফোটে বাগানের শিমুল ফুলগুলো।
চোখের তৃষ্ণা মেটাতে মেঘলয় পাহাড়ের পাদদেশে ও রূপের নদী যাদুকাটার মধ্যস্থলের বিশাল শিমুল বাগানে ফুটে ওঠা টুকটুকে লাল শিমুল ফুলগুলো দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন শতশত পর্যটক। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন পর্যটকরা।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কমনাসহ নানান অসুবিধার কথা জানিয়ে মনোমুগ্ধকর এই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের কথা তুলে ধরলেন পর্যটকরা। তাদের মতে এখানে দেশের অন্যান্য পর্যটন এলাকার মতো টুরিস্ট পুলিশের ক্যাম্প স্থাপন করা উচিত, যাতে করে পর্যটকরা নিরাপদে সময় কাটাতে পারেন।

পর্যটক লিজা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, প্রকৃতির রূপ লাবণ্যে সজ্জিত শিমুল বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছি। প্রতিটি গাছে এখন ফুল ফুটেছে। সত্যি খুব অসাধারণ।
স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তাক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছরের মতোই শীতের শেষে ফাল্গুন মাসজুড়ে শিমুল ফুল লাল পাপড়ি মেলে সৌন্দর্য বিলায়। যার ফলে বাগানটাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় লাল ফুলের গালিচা বিছিয়ে রেখেছে কেউ। এ সময় সাপ্তাহের সাত দিনই এখানে মানুষের ঢল নামলেও সরকারি ছুটির দিন পা ফেলার জায়গা থাকে না।
পর্যটক জুবায়ের আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হলে আরও বেশি পর্যটক আসবে এখানে। এছাড়া পর্যটকদের স্বার্থে বাগানটি আরও আধুনিকায়ন করলে মানুষের মাঝে আকর্ষণ বাড়বে।
শিমুল বাগানের প্রতিষ্ঠাতা জয়নাল আবেদিনের ছেলে রাকাব উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, বসন্তের শুরুতেই শিমুল ফুল দেখার জন্য প্রতিদিন পর্যটকরা দূর দূরান্ত থেকে আসছেন।
পর্যটকদের বাড়তি বিনোদনের জন্য স্থানীয়ভাবে সুসজ্জিত ঘোড়ার পিঠে উঠে ছবি তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া তাদের সুবিধার জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জল ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসারি বাসে সুনামগঞ্জ যেতে পারেন। এরপর সুনামগঞ্জ আব্দুল জহুর সেতু থেকে সিএনজি বা মোটরসাইকেলে জনপ্রতি একশ টাকায় লাউড়েরগড় বাজার। বাজার পার হয়ে যাদুকাটা নদী আর নদী পার হলেই শিমুল বাগান।
লিপসন আহমেদ/এফএ/এমকেএইচ