ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বীর মুক্তিযাদ্ধা কবি মফিজুল ইসলামের স্মৃতিচারণ

জেলা প্রতিনিধি | শরীয়তপুর | প্রকাশিত: ০২:২২ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২১

বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল ইসলাম কবিভাই। শরীয়তপুর সদর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের সুবেদারকান্দি গ্রামের মৃত মেঘাই সরদারের ছেলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরাসরি দেখেছেন। কথা বলেছেন। আজ জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীতে জাগো নিউজের কাছে সেসব স্মৃতিচারণই করেছেন তিনি।

জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে প্রথম কীভাবে জানলেন?

মফিজুল ইসলাম : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও তার ছয় দফা ঘোষণা প্রথম শুনি আমার বাবা মেঘাই সরদার ও স্থানীয় সুবেদারকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শরীফ আব্দুল জলিলের কাছে। আমি সেসময় হাইস্কুলের ছাত্র। সুবেদারকান্দি গ্রামে আমার দূরসম্পর্কের মামাত ভাই জয়নাল মুন্সি আমার থেকে ৮-১০ বছরের বড়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর পড়াশোনা করেননি। ঢাকার পোস্তগোলা ডাক প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিজে একটি রঙের কারখানায় চাকরি করেন। এক দুই মাস পর পর তিনি বাড়িতে আসতেন। আমাদের নিয়ে স্কুলমাঠে বসে ঢাকার নতুন নতুন খবর বলে আমাদের উৎসাহিত করতেন।

একবার তিনি ঢাকা থেকে এসে আমাদের বললেন, আইয়ুব খানের মন্ত্রী ভুট্টো সেদিন ঢাকা থেকে পালিয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘জয়নাল ভাই বিষয়টি একটু খুলে বলেন।’ তিনি বললেন, ‘শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণা করছে, দেশব্যাপী প্রচার হচ্ছে। আইয়ুব খানের মন্ত্রী ভুট্টো বলতেছে, এই শেখ মুজিবের ছয়দফা পাকিস্থান ভাঙার ষড়যন্ত্র, এটা পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থবিরোধীতো বটেই, বাঙালি জনগণেরও স্বার্থবিরোধী। সে শেখ মুজিবকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিছে। শেখ মুজিবও এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন।’

জয়নাল ভাই বললেন, ‘দু’জনের ছয়দফা নিয়ে যুক্তিতর্ক বাহাস হবে ঢাকায়। দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে, মঞ্চ তৈরি হইছে। মানুষ উপস্থিত হচ্ছে অনুষ্ঠানস্থলে, এই বাহাস শুনবে। আমরাও গেলাম। শুনলাম শেখ মুজিব আসতেছে। এর মধ্যেই খবর হচ্ছে ভুট্টো ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পালিয়ে গেছে। পরদিন খবরের কাগজেও সেটাই জানা গেল। এই পলায়নের মাধ্যমে শেখ মুজিবের ছয় দফা প্রথম বিজয় সূচিত হয়।’

জাগো নিউজ : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ে স্কুল শিক্ষার্থী থাকাকালেই আপনারা রাজপথে নেমেছিলেন। সে বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।

মফিজুল ইসলাম : আমাদের পালং থানার পাশে নড়িয়া থানা। সেখানে কর্নেল শওকত আলী ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। কর্নেল শওকত আলী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তখন আসামি। আমরা তখন হাইস্কুলে পড়ি। এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী আন্দোলন সংগ্রাম জোরেশোরে চলতে থাকে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও আন্দোলন শুরু করে। আমরা পালং তুলাসার গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয়ে স্যারদের প্রথম ক্লাসে রোলকল শেষে বেরিয়ে পড়ি এবং রাস্তায় এসে আন্দোলন সংগ্রাম করি। আমাদের স্লোগানের ভাষা ছিল, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হবে’, ‘জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব’, ‘জেলের তালা ভাঙব কর্নেল শওকতকে আনব’।

জাগো নিউজ : এরপর কী হয়?

মফিজুল ইসলাম : আন্দোলন সংগ্রামের চাপে আইয়ুব খান শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং মামলা প্রত্যাহার করে। এরপর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা সেকালের ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। সেই থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামে খ্যাতি অর্জন করেন।

জাগো নিউজ : আপনি কখন বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি দেখেন?

মফিজুল ইসলাম : আইয়ুব খান সেসময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরে পড়েন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দেন। সাধারণ নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার কাজেই একবার মাদারীপুরের নাজিমুদ্দিন কলেজ মাঠে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমরা পালং থানার কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সেই সমাবেশে অংশগ্রহণ করি। মঞ্চে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। করমর্দন করি। বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে, স্নেহ করে, আশীর্বাদ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য আলোয় তোমরা সুন্দর জীবন গঠন করবে’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন বিশ্ববরেণ্য নেতা। যিনি আমাদের জাতির পিতা। তার স্নেহ, আদর ও ভালোবাসা আমার পরম পাওয়া।

জাগো নিউজ : এরপর আপনারা কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতেন? এখনকার মতো প্রচারমাধ্যমতো তখন ছিল না।

মফিজুল ইসলাম : ১৯৭০ সালে সেই সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করে। নিয়ম অনুযায়ী জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা। জেনারেল ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে টালবাহানা শুরু করেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করেন না। ৭১’এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে বিশাল সমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণটা রেডিও ঢাকা সেন্টার থেকে প্রচার করার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রে সেটি প্রচার হয়নি।

শরীয়তপুরের বিনোদনপুর সুবিধারকান্দি গ্রামে একটা মাত্র রেডিও সেটা ছিল আমার। পরেরদিন সকাল ৮টার খবরের পর সাড়ে ৮টায় বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ঢাকা রেডিও সেন্টারে প্রচার করা হবে ঘোষণা করা হয়। আমি আমাদের গ্রামের সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই এবং উঠানে একটি জলচৌকির ওপর রেডিওটি রাখি। হোগলা বিছিয়ে দিই, মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনে। ভাষণ শুনে আমরা উদ্দীপ্ত হই।

জাগো নিউজ : রাজনীতির গতি এরপর কোনদিকে যায়?

মফিজুল ইসলাম : এরপর ইয়াহিয়া খান আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনী এনে পূর্বপাকিস্তান ভরে ফেলে এবং অপারেশন সার্চলাইট নামে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা অংশগ্রহণ করি। স্বাধীনতা সংগ্রাম আমার জীবনে একটি বড় অধ্যায়।

জাগো নিউজ : স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার অংশ নেয়া সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।

মফিজুল ইসলাম : স্থানীয় নেতা জাফর মীর, আবুল ফজল মাস্টার, আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কর্নেল শওকত আলী সাবসেক্টর কমান্ডার তখন। আমাদের জাতীয় নেতা প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। এক সময় আমি আমাদের গ্রামের ১৫/১৬ জনকে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারত চলে যাই। সেখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পাশে শিখ সেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল। সেখানে শিখ সৈন্য গ্রুপ কমান্ডারের সাথে মাঝেমধ্যে আমার কথা হতো।

তিনি আমাকে একবার প্রশ্ন করেন, তোমাদের দেশ স্বাধীন হলে তোমরা কী করবে? আমি বললাম, আমরা লেখাপড়া করব। দেশ গড়ার কাজ করব। আর আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করব। শিখ সেনার হাতে কালো বালা ছিল। তিনি আমার হাতে কালো বালাটি পরিয়ে দিয়ে বলেন, তোমার এই প্রতিজ্ঞার কাজ শেষ হওয়ার পর তুমি বালাটি খুলে ফেলবা।

জাগো নিউজ : ভারত থেকে ফেরার পর কীভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন?

মফিজুল ইসলাম : আমি ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে আসি। এসে দেখি আমাদের পালং থানা মুক্ত (তৎকালীন পূর্ব মাদারীপুর মুক্ত)। আমরা কোয়ারপুর পোদ্দারবাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগদান করি। এরপর মাদারীপুর রাজৈর থানা সমাদ্দায় কলাবাড়ি কলাগাইচ্ছা নামক স্থানে পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ হয়। সরাসরি যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে আমাদের স্থানীয় শওকত হোসেন নামে একজন মুক্তিযুদ্ধা তিনি গ্রুপ কমান্ডার, তাঁর সাথে ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সেই যুদ্ধ পরিচালনা করেন মাদারীপুরের কমান্ডার খলিলুর রহমান। তাকে আমরা মেজর খলিল বলতাম। সেই যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। ২৯ জন পাকিস্তানি সৈন্য ধরা পড়ে। তাদেরকে মিত্রবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।

Kobi-(2).jpg

আমাদের মুক্তি বাহিনীর পক্ষে আক্তার হোসেন হাওলাদার আহত হন। আর গ্রেনেড বাচ্চু শহীদ হন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় অর্জিত হয়।

জাগো নিউজ : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর?

মফিজুল ইসলাম : তখনও আমার বাবরি চুল। আমার মা তখন বলেন, বাবা দেশতো এখন স্বাধীন হইছে, তোমার চুল কেটে আস, আর হাতের বালাটা খুলে ফেল।

আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যতদিন মুক্তি না পাবে আমার হাতের বালাও খুলব না, চুলও কাটব না।

মা বললেন, বাবা তোমার হাত মোটা হয়ে যাবে। হাত কাইটা খুলতে হবে। আমি বলি, না মা সমস্যা হবে না।

জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পান তখন আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?

মফিজুল ইসলাম : বিশ্ব নেতাদের চাপে আমাদের বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলনের তোড়ে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। পরে সেই স্থানীয় আংগারিয়া বাজারে গিয়ে আমার মাথার চুল কাটাই এবং হাতের বালা খুলে ফেলি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জীবনে যে কত বড় পাওয়া আমি সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জীবনে একটা শ্রেষ্ঠতম অধ্যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আমি কাব্য চর্চা করি। কবিতা লেখি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ চলছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

ছগির হোসেন/এফএ/এসএইচএস/এমকেএইচ