মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন সিলেটের শাহী ঈদগাহ
সাতশ বছরেরও বেশি প্রাচীন শহর সিলেট। কালপ্রবাহে দেশের আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক কেন্দ্রবিন্দুতে সিলেটের অবস্থান। আর এসবের অন্যতম সাক্ষী ঐতিহ্যবাহী শাহী ঈদগাহ।
প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে এখানে বিশাল দুই ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ মুসল্লি একসঙ্গে এখানে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন। এখানেই সিলেটের সর্ববৃহৎ ও প্রধান ঈদ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে তিনশ বছরের ইতিহাস।
প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের কারণে সিলেটের ঐতিহাসিক শাহী ঈদগাহ ময়দানে বিগত ঈদের নামাজ হয়নি। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এবারও এখানে ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তিন শতাধিক বছরের ঐতিহ্য, উপমহাদেশের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র, দেশের প্রাচীনতম ঈদগাহ হিসেবে পরিচিত সিলেটের শাহী ঈদগাহ ময়দান। ১৭০০ সালের প্রথম দশকে মোগল স্থপতি ফৌজদার ফরহাদ খাঁ নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্যের এক নিদর্শন এই ঈদগাহ।
সিলেট শহরের এ স্থানটি নানা কারণে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও স্মরণীয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৭৭২ সালে ব্রিটিশবিরোধী ভারত-বাংলা জাতীয়তাবাদী প্রথম আন্দোলন সৈয়দ হাদী ও মাদী কর্তৃক এই ঈদগাহ মাঠেই শুরু হয়েছিল। অতীতে সিলেটের বড় বড় সমাবেশের স্থান ছিল এটি।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতাদের পদচিহ্ন পড়েছে এখানে।

একটি উঁচু টিলার ওপর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এই শাহী ঈদগাহ অবস্থিত। মূল ভূ-খণ্ডে কারুকার্যখচিত ২২টি বৃহৎ সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি মাড়িয়ে ওপরে উঠলে ১৫টি গম্বুজ সজ্জিত মূল ঈদগাহ দেখা যায়। টিলার মূল ঈদগাহের সামনের দিকে আটটি গুম্বুজ।
নিচে বৃক্ষ ছায়ায় বিস্তৃত মাঠ এবং সীমানা প্রাচীরের চারদিকে রয়েছে ছোটবড় ১০টি গেট। তবে ঈদগাহের সামনের দিকে রয়েছে মূল তিনটি গেট। ঈদগাহের সামনে মুসল্লিদের অজুর জন্য রয়েছে একটি পুকুর।
ঈদগাহের উত্তরে শাহী ঈদগাহ মসজিদ, পাশে সুউচ্চ টিলার ওপর বন বিভাগের বাংলো, দক্ষিণে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সিলেট কেন্দ্র, পূর্ব দিকে হযরত শাহজালালের সফরসঙ্গী শাহ মিররাজী (রহ.)-এর মাজারের পাশের টিলার ওপর রয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস।

পাহাড়ের টিলায় সবুজ আচ্ছাদিত পরিবেশে এ ঈদগাহ কেবল ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারকই নয়, যেন নগরজীবনে প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু। পাহাড়-টিলা আর হাজারো বৃক্ষরাজির মধ্যে এর মনোমুগ্ধকর অবস্থান নজর কাড়ে যে কারো।
শত শত বছরের ঐতিহ্য, মনোমুগ্ধকর কারুকার্যময় এ ঈদগাহটি নির্মাণ করেন মোগল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ। তখন মোঘল সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব।
মূল তিনটি গেটে মুঘল আমলের স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট। ২০০১ সালে বড় পরিসরে তিনটি গেটের সংস্কার করে দেন স্থানীয় ব্যবসায়ী হাজারীবাগ নীরু মঞ্জিলের বাসিন্দা জহির উদ্দিন তারু মিয়া। ওই বছরের ১৫ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর উদ্বোধন করেন।
ঈদগাহের ভেতরের ফলক অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পুকুরের চারদিকে ঘাট নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।পাশাপাশি ২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর ঈদগাহে বিদ্যুতায়ন, সংস্কার ও চারদিকে ফুটপাত নির্মাণকাজেরও উদ্বোধন করেন তিনি।

সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশন ঈদগাহটির নিরাপত্তা প্রাচীর কারুকার্যময় করে নির্মাণ করেছে। ঐতিহ্যবাহী এই ঈদগাহটির চারপাশে পাকা সড়কপথ আর সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ঈদগাহ ঘিরে রয়েছে দেশি-বিদেশি কয়েকশ প্রজাতির বৃক্ষ।
সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন এই স্থানটি এখন নানা কারণে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। এই ঈদগাহ ময়দানে বিভিন্ন সিনেমারও শুওটিং হয়েছে। নায়ক সিয়াম একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যয়ন রেকর্ড করতে এসে এখানে নামাজ আদায় করেন। তখন এ দৃশ্যটি ভাইরাল হলে এনিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়।
উন্মুক্ত উদ্যানহীন সিলেট নগরে অনেকেই বিকেলে শাহী ঈদগাহের খোলা ময়দানে হাঁটাহাঁটি করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন অনেক নারী। তবে ঈদগাহের পবিত্রতা রক্ষার কথা বলে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে শাহি ঈদগাহ ময়দানে নারী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরে ওই নিষেধাজ্ঞা আর বেশিদিন টেকেনি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটের শাহী ঈদগাহটির আধুনিকায়নে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি নিরাপত্তা প্রাচীর নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। বছর দুই আগে পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে আল্লাহু চত্বর নতুন নির্মাণশৈলীতে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে শাহী ঈদগাহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ এই ঈদগাহের আধুনিকায়নে সিটি করপোরেশন সবসময় আন্তরিক।’
শাহী ঈদগাহ সংলগ্ন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও সিলেট বিভাগ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদ সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান খোকন বলেন, ‘তিনশ বছরের প্রাচীন শাহী ঈদগাহ সিলেট নগরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। প্রতি বছর দুই ঈদে সিলেট বিভাগের সর্ববৃহৎ ও প্রধান ঈদ জামায়াত এখানে অনুষ্ঠিত হয়। একসঙ্গে প্রায় দেড়লাখ মানুষ নামাজ আদায় করেন। মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক ভিআইপি এখানে ঈদ জামাতে অংশ নেন। কিন্ত করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিগত বছর প্রথমবারের মতো ঈদের জামাত এই ঈদগাহে হয়নি। আমরা যেন এই ঈদগাহে সবাই মিলে একসঙ্গে আবার নামাজ আদায় করতে পারি সেই দোয়া করছি।’
শাহী ঈদগাহের মোতায়াল্লি আলহাজ জহির বখত। বর্তমানে তিনি পারিবারিক প্রয়োজনে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। তাই এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
ছামির মাহমুদ/এসআর/জেআইএম