ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

গণমানুষের হৃদয়ে চিরভাস্বর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী

জেলা প্রতিনিধি | পাবনা | প্রকাশিত: ০২:৫৬ পিএম, ০৩ নভেম্বর ২০২১

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান। এই চারটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগিয়েছিলেন আশা, মলিন মুখে জুগিয়েছিলেন ভাষা।

জাতির এ চার সূর্য সন্তানকে ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হয়ত সম্ভব না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম ভূমিকা রেখেছেন এই চারজন। শত প্রলোভনের হাতছানি মাড়িয়ে আর ঘাতকের বুলেট উপক্ষো করে তারা প্রাণ দিয়েছেন।

jagonews24

সেসব কথা জাতি ভুলে যায়নি। তাইতো গণমানুষের হৃদয়ে তারা এখনও চিরভাস্বর হয়ে আছেন। বাঙালি জাতির গর্ব এ চার কৃর্তীমানের অন্যতম একজন বৃহত্তর পাবনার সন্তান শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু যাকে নিজ হাতে গড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত, ঘনিষ্ঠ ও ভালোবাসার পাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জীবন দিয়ে তা তিনি প্রমাণ করে গেছেন।

শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর জন্ম শতবর্ষ পার হয়েছে ২০১৯। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ পার হয়েছে ১৯২০। এ এক দারুণ অন্ত্যমিল! শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের ‘কুড়িপাড়া’ গ্রামে ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম হরফ আলী সরকার।

jagonews24

পড়াশোনা শুরু করেন কাজীপুরের গান্ধাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন গান্ধাইল হাইস্কুলে। এরপর চলে আসেন সিরাজগঞ্জ বিএল হাইস্কুলে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সেখান থেকেই। এরপর চলে আসেন পাবনা। ভর্তি হন এডওয়ার্ড কলেজে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন এই কলেজ থেকেই। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৪১ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

এরপর ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯৪৫ সালে সেখান থেকেই অর্থনীতিতে এমএ এবং ল’ পাস করেন। এলএলবিতে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। সেসময় প্রত্যন্ত জনপদের একজন সাধারণ কৃষক পরিবার থেকে এমন উচ্চ শিক্ষিত হওয়াটা ছিল বিরল দৃষ্টান্ত।

jagonews24

আলীগড় থেকে দেশে ফেরার পর তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এই নবীন আত্মসচেতন ব্যক্তি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ছিলেন পাবনা জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি। ১৯৪৮ সালে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ নেন এবং পিএলজির ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর নামে পরিচিত হতে থাকেন।

১৯৫১ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন এবং দলের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।

১৯৫১ সালেই তিনি স্বাধীন পেশা হিসেবে ওকালতিকে বেছে নেন। আইনজীবী হিসেবে ছিলেন পাবনা জেলা আদালতে। পাবনা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতিও ছিলেন তিনি।

jagonews24

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে পাবনা-১ আসনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। আবদুল্লাহ আল মাহমুদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়।

১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময় পূর্ববঙ্গ কোয়ালিশন সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করেন। পাবনা-১ আসন থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আবার পাবনা-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ বছর তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) সেক্রেটারি জেনারেলও ছিলেন তিনি।

jagonews24

এরপর সেই কালো দিন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। এদিন মধ্যরাতে অশুভ শক্তির চক্রান্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাকেসহ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দেশের জাতীয় চার নেতাকে।

রাজনৈতিক জীবনে যেমন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী বঙ্গবন্ধুর মতো সাধারণ জীবনযাপন করতেন তেমনি ছিল তার ব্যক্তিজীবন। এমনটাই জানিয়েছেন তার এলাকার প্রবীনজন ও নিকট আত্মীয়রা।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার কীর্তিগাঁথাকে স্মরণ রেখেছেন বৃহত্তর পাবনার মানুষ। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর মোড় কিংবা ডাকবাংলোতে স্বাধীনতা স্কোয়ারে তাদের অনবদ্য ম্যুরাল সব প্রজন্মের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

এখনও বৃহত্তর পাবনা এলাকার প্রবীণরা তাকে স্মরণ করে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। শিশু-কিশোর-তরুণেরা তার জন্য গর্ব অনুভব করেন। হতে চান তার মতো দেশপ্রেমিক।

বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর এম মনসুর আলীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তার দুই ছেলে ও এক নাতি রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। এম মনসুর আলীর তিন ছেলের মধ্যে মোহাম্মদ নাসিম এবং ড. মোহাম্মদ সেলিম এবং নাতি তানভীর শাকিল জয় সংসদ সদস্য হয়েছেন। ড. মোহাম্মদ সেলিম ও মোহাম্মদ নাসিম মারা গেছেন। এদের মধ্যে মোহাম্মদ নাসিম আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণ ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্র, ডাক- তার, পূর্ত ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

আমিনুল ইসলাম জুয়েল/এফএ/জিকেএস