আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না ভাষাসৈনিক দবিরুল ইসলাম
ইনসেটে ভাষাসৈনিক দবিরুল ইসলাম এবং তার পরিবারবর্গ
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অ্যাডভোকেট দবিরুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা পর্বে যে কজন সাহসী সূর্য সন্তান তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, দবিরুল ইসলাম তাদেরই একজন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন, যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন এ সবের পিছনে অসামান্য অবদান রেখেছেন ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলাম। তৎকালীন সময়ে অনলবর্ষী বক্তা হিসেবেও তরুণ ছাত্রনেতা দবিরুলের খ্যাতি ছিল চারদিকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহত্তর দিনাজপুরের তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার বামুনিয়া গ্রামে ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন দবিরুল ইসলাম। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখা শুরু করেন। লাহিড়ী এম.ই হাই স্কুল থেকে বিভাগীয় বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজশাহী বিভাগীয় ‘মায়াদেবী উন্মুক্ত রচনা প্রতিযোগিতায়’ লাভ করেন স্বর্ণ পদক। এরপর ১৯৩৮ সালে ঠাকুরগাঁও থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। এখান থেকে আই.এ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান নিয়ে বোর্ড স্ট্যান্ড করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের শিকার হন তিনি। আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতার হলে তখনও তার ওপর ব্যাপক নির্যাতন চলে। জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াড়াঙ্গি উপজেলার পাড়িয়া গ্রামে চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন এ ভাষা সৈনিক।
তবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাবে ইতিহাসের স্মৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছেন দবিরুল ইসলাম। তাই ভাষা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ত্যাগী এই সৈনিকের অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে স্বীকৃতির পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ে তার জীবন-দর্শন অন্তর্ভুক্তিরও দাবি উঠেছে তার পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে।
কীর্তিমান এ রাজনীতিবিদের জীবন সম্পর্কে ঠাকুরগাঁও জেলার ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আকবর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে দবিরুল ইসলামের সঙ্গে আরও অনেকে কারাবন্দি হন। দিনাজপুর কারাগারে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। এতে তার হার্টের একটি ভাল্ব নষ্ট হয়ে যায়। যার কারণে ধুকে ধুকে মারা যান তিনি।’

ভাষা সৈনিকের ছেলে বুলবুল আহম্মেদ আক্ষেপ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ষাট বছর পরও জাতীয়ভাবে বাবাকে (দবিরুল ইসলাম) মূল্যায়ন করা হয়নি। সরকারি উদ্যোগে তার স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যা কিছু করা হয়েছে তার সব কিছুই পারিবারিক প্রচেষ্টায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হোক এবং তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যাতে নতুন প্রজন্ম ভাষা আন্দোলন এবং তার জীবনী জানতে পারে।’
দবিরুলের স্ত্রী আবেদা ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার স্বামীর ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার স্বামীকে জাতীয়ভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। সরকারের কাছে শুধু আমার স্বামীর রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন চাই।
লাহিড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, দবিরুল ইসলামের জীবন দর্শন, ভাষার জন্য অবদানের কথা নতুন প্রজন্মকে জানাতে তার জীবনী পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হলে নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি মরেও বেঁচে থাকবেন।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কয়েক বছর আগে মরহুম দবিরুল ইসলামকে জেলা প্রশাসনের পক্ষে সম্মাননা জানানো হয়েছে। এছাড়া তার স্মৃতিস্তম্ভ আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। তার জীবনী পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।
তানভীর হাসান তানু/এসজে/জেআইএম