ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

চাষির নগদ টাকার অভাবে হালখাতার আনন্দ মলিন

আমিন ইসলাম জুয়েল | প্রকাশিত: ১০:৫৭ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০২২

পাবনায় নতুন বছরে এবার হালখাতা জমেনি। চাষিরা বকেয়া টাকা পরিশোধ করছে না বলে ব্যবসায়ীদের মুখ মলিন। পেঁয়াজ-রসুনচাষ প্রধান এ এলাকার চাষিরা বলছেন দাম না পাওয়ায় তারা দোকানের বাকি শোধ করতে পারছেন না।

পাবনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হালখাতায় দোকান সাজানো হয়েছে, মিষ্টি- মণ্ডার আয়োজন সবই ঠিক আছে। শুধু নেই সারাবছর বাকিতে নেওয়া ক্রেতারা। হালখাতায় তারা দোকানের বাকি শোধ না করে ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করে চলে যাচ্ছেন।

আতাইকুলায় একটি দোকানে হালখাতা চলা অবস্থায় গিয়ে কথা হয় ব্যবসায়ী আ. লতিফের সঙ্গে।

তিনি জানান, তার ক্রেতারা সারাবছর বাকি নিয়েছেন। কথা ছিল তারা পেঁয়াজ-রসুন তুলে বকেয়া শোধ করবেন। কিন্তু বকেয়া শোধের পরিমাণ হতাশাজনক।

jagonews24

তার কথার প্রমাণ মেলে দোকানে আসা শহীদ প্রামাণিক নামের এক ক্রেতার কথা শুনে। শহীদ প্রামাণিক জানালেন, ‘তার কাছে দোকানদার পাবেন ২৮শ’ টাকা। হাতে টাকা নেই বলে বাকি শোধ করতে পারছেন না। মাত্র ৫০ টাকা দিয়ে দোকানদারের সঙ্গে দেখা করে চলে যাচ্ছেন।’

টাকা শোধ করতে পারেননি কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, পেঁয়াজ-রসুনের দাম খুবই কম। হাটে নিয়েও ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। তাই হাতে নগদ টাকা নেই।

একই চিত্র দেখা গেলো সাঁথিয়া উপজেলার মাধপুর বাজারে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাকিতে নেওয়া একজন ক্রেতাও তখন দোকানে নেই।

প্লাম্বার দোকানের ম্যানেজার বিপ্লব দাস জানান, তাদের দোকানে ৭ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। কিন্তু এক লাখ টাকাও উঠবে না হালখাতায়।

তিনি জানান, হালখাতার আয়োজন করেছি। কিন্তু বকেয়া টাকা শোধ করতে কেউ আসছেন না। হালখাতা দিয়েই যেন আমরা বোকা সেজে গেছি।

তিনি জানান, কৃষক পরিবারের লোকজনই তাদের খরিদ্দার। তারা টাকা দিতে পারছেন না, কেন পারছেন না তাও তারা জানেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোতো আর বকেয়া রাখছেন না।

jagonews24

অনেক ব্যবসায়ী এনজিওর সঙ্গে জড়িত। যাদের কাছে থেকে ঋণ নিয়ে দোকানিরা ব্যবসা করেন। এনজিও কর্মীরা হালখাতায় হাজির হয়েছেন তাদের পাওনা নেবেন বলে। কিন্তু তারাও হতাশ হচ্ছেন মহাজনদের বকেয়া উঠছে না বলে।

মো. আবু বকর সিদ্দিক এমনই এনজিওকর্মী। তিনি এসেছেন তাদের দেওয়া ঋণের টাকা নেওয়ার জন্য। কিন্তু দোকানগুলোতে হালখাতার যে অবস্থা তাতে তারা তাদের টাকা পাচ্ছেন না বলে জানান। এতে তারাও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানান।

আতাইকুলা থানার বনগ্রাম বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব এসএম নবীউল আলম জানান, চাষিরা সারা বছর কিছু টাকা পরিশোধ করে জিনিসপত্র নেন। তারা সাধারণত বৈশাখ মাসের হালখাতায় বকেয়া টাকা শোধ করেন। কারণ চৈত্র মাসের মধ্যে তাদের ফসলাদি ঘরে ওঠে। এজন্য দীর্ঘ ঐতিহ্য ধরে রেখে বৈশাখ মাসে হালখাতা করা হয়। এবার এ এলাকার চাষিরা ফসল উৎপাদন করে মার খেয়েছেন, তাই তাদের হাতে নগদ টাকা নেই। তারা দেনায় জর্জরিত। তাই এবারে হালখাতা করে কোনো ব্যবসায়ী বকেয়া টাকা তুলতে পারছেন না।

jagonews24

এদিকে বছরের শুরুতেই হালখাতার চিঠি পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সুজানগর উপজেলার দহেরপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল বাতেন। তিনি কয়েক বিঘা পেঁয়াজ লাগিয়েছিলেন। পেঁয়াজ হাটে নিয়ে এসে যে দাম পাচ্ছেন তাতে তার উৎপাদন খরচই উঠছে না বলে জানিয়েছেন।

একই কথা বললেন রসুনচাষি জসিম উদ্দিন। জানান, চাষাবাদ করতে সার-কীটনাশক দোকান থেকে বাকি এনেছেন। মুদি দোকানেও বাকি। এখন চাষের টাকায় দোকানের বাকি শোধ করতে পারছেন না।

পাবনার পেঁয়াজ প্রধান এলাকা বনগ্রাম বণিক সমিতির সেক্রেটারি আলহাজ্ব আব্দুর রহিম বাবু জানান, পয়লা বৈশাখ আর হালখাতা যেন অনেকটা যমজ ভাই-বোনের মতো। এ দিনটি ব্যবসায়ীদের কাছে আনন্দের দিনও বটে। হালখাতা শুধু হিসাবের নতুন খাতা খোলা নয়, পাওনা আদায়ের পাশাপাশি ক্রেতাদের আপ্যায়ন হালখাতার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য।

পাবনা সদর উপজেলার দুবলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক পরিচালক আব্দুল খালেক খাঁন জানান, এখন ব্যাংকেও হালখাতা হয়। অনেক কিছু পাল্টে যাচ্ছে। আগের মতো উল্লাস নেই তবে এর আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। এখন নতুন করে যোগ হয়েছে হালখাতা শেষে রাতে মহাজনের বাড়িতে খাবারের আয়োজন। সেখানে খুব কাছের দু-চারজন ক্রেতা, দোকান কর্মচারি ও আত্মীয়-স্বজন থাকেন।

jagonews24

পাবনার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও মাহাতাব বিশ্বাস রিয়েল এস্টেট লি. এর এমডি অধ্যক্ষ (অব.) আলহাজ্ব মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস জানান, পয়েলা বৈশাখ থেকে হালখাতা শুরু হয়ে চলে পুরো মাস জুড়ে। বাঙালির আনন্দ উৎসব আর সম্প্রীতির গৌরবগাঁথা হলো হালখাতা। চাষিদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় আবার রোজার দিন বলে এবার হালখাতা উৎসবে ভাটা পড়েছে।

পাবনার বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত কৃষক আলহাজ্ব শাহজাহন আলী জানান, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে একটু ভাটা পড়লেও একেবারে গুটিয়ে যায়নি হালখাতা। ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতাদের আপ্যায়ন করছেন, পুরোনো হিসাবের খাতা বন্ধ ও নতুন বছরে নতুন খাতা খোলার আনন্দ উল্লাস, মিষ্টিমুখ ও আনুষ্ঠানিকতা সবই করে যাচ্ছেন কিন্তু দোকানিদের বাকি টাকা ঠিকমতো উঠছে না। কারণ কৃষকের হাতে নগদ টাকা নেই।

এফএ/এএসএম