সুদিনের আশায় বান্টি গ্রামের মানুষ
ভেজা কাপড় রোদে শুকানো হচ্ছে। ছবি-জাগো নিউজ
ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের পছন্দের তালিকায় রয়েছে বাটিক পোশাক। এ পোশাক পরতেও আরামদায়ক। চাহিদা থাকায় একসময় লাভজনক ছিল বাটিকের ব্যবসা। তবে বর্তমানে পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় বাটিকের ব্যবসা আর আগের মতো নেই।
বেচাকেনা না থাকায় বিকল্প পেশা খুঁজছেন পারিবারিকভাবে এ ব্যবসায় জড়িতরা। আর যারা এ পেশাকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চান সুদিনের আশায় রয়েছেন তারা। সম্প্রতি বাটিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নের বান্টি গ্রামে গেলেই চারদিকে দেখা মিলবে রং-বেরঙের কাপড়। রাস্তায়, বাড়ির উঠান, ভবনের ছাদ বা খোলা ময়দানে বাটিকের নকশা করা ওড়না, সালোয়ার, কামিজ, বিছানার চাদর ও বালিশের কভারের কাপড় শোভা পাচ্ছে। গ্রামটি এখন বাটিকের গ্রাম বলেই পরিচিত।
সম্প্রতি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সাদা কাপড়ে বাটিকের নকশা করছেন শত শত মানুষ। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কেউ কাপড়ে রঙ দিচ্ছেন, কেউ ব্লক করছেন, আবার কেউ ভেজা কাপড় রোদে শুকাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ কাপড় ভাঁজ করছেন। তারা পারিবারিকভাবেই এ কাজের সঙ্গে জড়িত বলে জানান। কেউ কেউ আবার ছোট ছোট কারখানা গড়ে তুলে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে কাজ করছেন।

একসময় এই বাটিকানদের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ। কিন্তু কালের বিবর্তনে শিল্পের ছোঁয়ায় তারা বদলে গেছেন। কৃষিকাজ ছেড়ে নিজেদের ভাগ্য বদলে বেছে নিয়েছেন বাটিকের কাজ। পরিবারের ছোট-বড় সবাই এখন এ পেশায় জড়িত।
গরমকালে চাহিদা বাড়ে বাটিকের
আড়াইহাজারের বান্টি বাজারের ফ্যাশন থ্রি-পিসের মালিক আবুল খায়ের জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈদের সঙ্গে এ ব্যবসার তেমন কোনো সম্পৃক্ততা নেই। গরমের সময়ই মূলত এই কাপড়ের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু এবার তেমন চাহিদা দেখা যাচ্ছে না। এখন আর আগের মতো ব্যবসা নেই। আগে যে রকম ব্যবসা হতো এখন আর সেরকম হয় না।’

হৃদয় নামের এক বাটিক শ্রমিক বলেন, ‘আমাদের এই ব্যবসাটা গরমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গরমের সময়ে আমাদের বেচাকেনা বাড়ে। তখন আমাদের কাজও বাড়ে।’
বান্টি গ্রামের সুমাইয়া ডাইংয়ের মালিক সাইফুল ইসলাম শান্ত। তিনি জানান, বর্তমানে সুতার দাম বেড়েই চলছে। সুতার দাম বাড়ার কারণে কাপড়ে গজপ্রতি ১০ টাকা করে বেড়েছে। রঙের দাম বেড়েছে দিগুণ। আগে বস্তাপ্রতি কাস্টিং ছিল ২ হাজার ২০০ টাকা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৪০০০ টাকা। কেমিক্যালের দামও বেড়েছে। বস্তাপ্রতি সোডা ছিল ১৭০০ টাকা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৩৫০০ টাকা। এভাবে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বাড়ছে। যে কারণে এই ব্যবসাটা এখন ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘জিনিসের দাম বাড়ার কারণে আমাদের তেমন লাভ হয় না। যাদের কাছ থেকে কাপড় আনি তারা ঠিকমতো টাকা দেয় না। অন্য বছর এ সময়ে হরদম কাজ চললেও এবার আমরা বসে রয়েছি। কোনো কাজ নেই। জিনিসের দাম বেড়েছে শ্রমের দাম বাড়েনি।’
দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে বাটিক পেশার সঙ্গে জড়িত শিল্পী আওলাদ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বেড়েছে কিন্তু আমাদের শ্রমের দাম বাড়েনি। আগে প্রতিমাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন তুলতে পারতাম। বর্তমানে সেই বেতন আরও বাড়া তো দূরের কথা, এখন ১২ হাজার টাকা তুলতেই কষ্ট হয়ে যায়।’

‘সামনে ঈদ আসছে। পরিবারের সদস্যরা আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু ডাইংয়ের কাজ বন্ধ থাকায় বসে আছি। করোনার সময়েও আমাদের এতো কষ্ট হয়নি। এইবার করোনা নেই। তারপরও বেতন নিয়ে বাড়ি যেতে পারবো কিনা সংশয়ে রয়েছি’, যোগ করেন এ বাটিক শিল্পী।
দেখা মেলে না লাভের
আজিজুল ডাইয়ের মালিক আজিজুল বলেন, ‘আগে বাপ-দাদারা এই ব্যবসা করতেন। আমি সাত বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছি। তিন বছর আগেও বছরে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা আয় করতাম। আর এখন লাভ কী জিনিস চোখে দেখি না।’

তিনি বলেন, ‘আমার এখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করে। তাদের বেতন দিয়ে আর কিছুই থাকে না। আমি নিজে মালিক। আমার নিজেরই সংসার চলে না। সরকার হস্তক্ষেপ করলে হয়তো এ ব্যবসার সুদিন ফিরে আসতো।’
দিন দিন বাটিক ব্যবসা খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে জানান দুলাল ডাইংয়ের কর্মচারী সাইফুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে আমাদের প্রায় সবসময় কাজ থাকতো। নির্দিষ্ট ডিউটির বাইরে গিয়ে ওভারটাইম কাজ করতে পারতাম। এখন ঠিকমতো ডিউটিই হয় না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বড় হয়েছি এই কাজ দেখে। এখন লাভের মুখ দেখা যায় না। আগে প্রায় অর্ধেক লাভ হতো। এখন পিসপ্রতি ১ টাকা লাভ তোলাটাও কষ্ট হয়ে যায়। এক বছর আগেও পিসপ্রতি ৩ টাকা করে লাভ পাওয়া যেতো।’
সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হয় সুতার দাম
ভাই ভাই প্রিন্টের মালিক কুদরত আলী বলেন, ‘বড় বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে এই ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সিন্ডিকেট করে সুতার দাম বাড়ানো হয়। চিন্তা করছি এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও কাজ নেবো।’

তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে আমার প্রায় তিন লাখ টাকা। কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারি না। আমরা তিন ভাই মিলে কাজ করি। আমাদের এখন ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে।’
দুপ্তারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহিদা মোশারফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বান্টি গ্রামের প্রায় সবাই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এটা তাদের নিজস্ব ব্যবসা। শ্রমিকও নিজেদের এলাকার। তাদের ব্যবসাটা লাভজনক। বর্তমানে যেহেতু করোনাসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। সে কারণে হয়তো তাদের ব্যবসাটাও ভালো যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, এ ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। আগে প্রতিযোগিতা কম ছিল। এখন ১০০ জনের জায়গায় ৫০০ জন ব্যবসা করেন। এসব কারণে ব্যবসা খারাপ যেতে পারে।

এ বিষয়ে আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এটা তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসা। তারপরও তারা যখনই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন আমরা সহযোগিতা করি। আমরা তাদের পাশে আছি।
এসআর/এমএস