সমুদ্রে মাছ সংকট, পেশা ছাড়ছেন জেলেরা
সমুদ্রে মাছ সংকটে বিপাকে কুয়াকাটার জেলেরা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বৈরি আবহাওয়া, পর্যটনকেন্দ্রের মাত্রাতিরিক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য পানিতে ফেলাসহ নানা কারণে কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূলে মাছ সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে মহাজনের দাদনের টাকা শোধ করতে না পেরে এলাকা ছেড়েছেন অনেক জেলে। অনেকে আবার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে নতুন পেশা খুঁজছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, পটুয়াখালীর বড় দুটি মৎস্য বন্দর আলীপুর ও মহিপুর। এর পাশাপাশি কুয়াকাটা, চাপলি বাজার, বাবলাতলাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বসে ছোট-বড় মাছের আড়ৎ। একসময় বছরে জৈষ্ঠ্য থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত সবগুলো আড়ৎ থাকতো ইলিশে ভরপুর। এছাড়া বাকি মাসগুলোতে ইলিশের পরিমাণ কম থাকলেও লইট্টা, পোয়া, কোরাল, বাইলা, ছুড়ি, চাপিলাসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছে সয়লাব থাকতো আড়তগুলো। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, বৈরী আবহাওয়া, উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ডুবো চর, অতিরিক্ত প্লাস্টিক বর্জ্যের সমারোহ, ঘন ফাঁসের জাল দিয়ে পোনা নিধনসহ নানা কারণে জেলেরা এখন মাছ সংকটে পড়ছেন।

তেমনই একজন জেলে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন ঝাউবন এলাকার জেলে হারুন ফরাজি। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জেলে পেশাকে আঁকড়ে রেখেছেন তিনি। কিন্তু সেই আশা এখন নিরাশায় পরিণত হয়েছে। জেলে জীবনের ২৫ বছর পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো কাটলেও গত পাঁচ বছর ধরে বেড়েই চলেছে তার মহাজনের দাদনের বোঝা।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় হারুনের মতো প্রায় ২০ হাজার নিবন্ধিত জেলে আছেন। তবে তাদের অনেকেই এখন সংসার, পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকতে খুঁজছেন ভিন্ন পেশা। আবার অনেকে ঋণের বোঝা সইতে না পেরে এলাকা ছেড়েছেন।

হারুন ফরাজি জাগো নিউজকে বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। আমরা একসময় প্রতিদিন ২-৩ কেজি ওজনের ইলিশ মাছ পেতাম কিন্তু এখন দুই হাজার পিস ইলিশের মধ্যে ১-২টি এক কেজি ইলিশ পাওয়া দুষ্কর।
তিনি বলেন, একদিকে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ সংকট অন্যদিকে প্রতিদিন বাড়ছে মহাজনের দাদনের বোঝা যা প্রতিটি জেলেকে এখন দুশ্চিন্তা ফেলেছে। যে কারণে প্রতিবছরই মৌসুম শেষে অনেক জেলে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সংসার চালানোর জন্য জেলে কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ অনেক জেলেরই জানা নেই তাই বাধ্য হয়েই এ পেশায় থাকতে হচ্ছে।

আরেক জেলে হারুন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, একসময় ইলিশ মৌসুমে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতাম। ২২ দিনের অবরোধে এটা আমরা শতভাগ মেনে চলছি কিন্তু এখন ২২ দিনের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও ৬৫ দিনের অবরোধ। বার বার আবহাওয়া খারাপ, ভারতীয় জেলেদের ৬৫ দিনের অবরোধে ছোট-বড় টনকে টন মাছ শিকার করে নেওয়া, মাছ ধরার জাল ও সুতার দাম বৃদ্ধিসহ অনেকগুলো কারণ এখন জেলেদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে যার ফলে বছর শেষে আমাদের ঋণ বেড়েই চলেছে।
হারুন অভিযোগের কণ্ঠে বলেন, ৬৫ দিনের অবরোধে আমরা সমুদ্রে নামতে পারি না, প্রশাসন আমাদেরকে জেল-জরিমানা করে কিন্তু এই সময়ে ভারতের জেলেরা অহরহ ছোট-বড় মাছ ধরে নিচ্ছে। তারা বাংলাদেশের জলসীমায় ঢোকে কিন্তু এটা নিয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকার যদি আমাদেরকে বাঁচাতে চায় তাহলে এসব বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
দীর্ঘ ১৫ বছর সমুদ্রে মাছ শিকার করে অবশেষে ১০ লাখ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন কুয়াকাটার জেলে সেলিম মাঝি। মুঠোফোনে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, একটা সময় সমুদ্রে অনেক মাছ পেতাম, তাই এই পেশাকে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার পক্ষে না থাকায় পরিবার-পরিজন রেখে এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে এসেছি। এখানে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছি। শুধু যে আমি একা এমনটা নয় আমাদের সঙ্গে মাছ ধরতো এমন অনেক লোক এলাকা ছেড়েছেন শুধু মাছ না থাকার কারণে।

কুয়াকাটা থেকে চট্টগ্রাম আসা আরেক জেলে আবু সাঈদ (৪২) জাগো নিউজকে বলেন, আমি ২৫ বছর জেলে পেশায় ছিলাম কিন্তু এই পেশায় থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণী হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এখন দিনমজুরের কাজ করি। প্রতি বছর ঋণ বাড়ছে তাই দুমুঠো ভাত খেয়ে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পেশা পরিবর্তন।
কুয়াকাটার জেলেদের সংগঠন আশার আলোর সভাপতি নিজাম শেখ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে সমুদ্রের জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছি। গভীর সমুদ্রে যে মাছ ধরা পড়তো সে কথা বাদ দিলাম। তীরবর্তী এলাকায় স্বাভাবিক যে মাছ দেখা যেত তা এখন গভীর সমুদ্রেও মেলে না। যে কারণে জেলেরা এখন হাতাশায় ভুগছেন। সরকারি আদেশ অনুযায়ী ২২ দিনের অবরোধ জেলেরা কোনো অভিযোগ ছাড়াই মেনে চলে কিন্তু ৬৫ দিনের অবরোধকে ঘিরে জেলেদের অনেক অভিযোগ রয়েছে, আশা করবো সরকার বিষয়গুলোতে নজর দেবে।
জেলেদের পেশা পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু সেলিম মাঝি ও আবু সাঈদ নয়, আমার চোখে দেখা শতশত জেলে এখন এই পেশা ছেড়ে কেউ ভ্যান-রিকশা চালায়। আবার কেউ এলাকা ছেড়েছেন মহাজনের দাদনের ঋণের বোঝা সইতে না পেরে। প্রতিবছরই পেশা পরিবর্তনকারী জেলেদের সংখ্যা বাড়ছে। ভবিষ্যতে এটা মৎস্য সম্পদের জন্য অনেক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তিনি জেলেদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, কৃষকের মতো জেলেদের জন্য বার্ষিক ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হলে তারা কিছুটা স্বস্তিতে দিন কাটাতে পারতো। এমন ব্যবস্থার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে সমুদ্র ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের সংকট রয়েছে। তবে ধারণা করা যাচ্ছে, আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি দেখা দিলেই মাছের দেখা মিলবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ চ্যানেলে অতিরিক্ত পলি পড়ার কারণে ইলিশের গতিপথে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, খুব শিগগির একটা সমাধানে পৌঁছাতে পারবো।

জেলেদের পেশা পরিবর্তন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমুদ্রে মাছ সংকটের কারণে জেলেরা পেশা পরিবর্তন করছে এটা ঠিক। তবে প্রতিনিয়ত জেলে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর সমুদ্রের ধারণক্ষমতার বেশি জেলে মাছ শিকারে যাচ্ছে, যা এই সংকটের অন্যতম কারণ। তাই অনেকেই এই পেশাকে স্থায়ী করতে পারছে না। সরকার এই ধরনের জেলেদের জন্য বিকল্প টেকসই কর্মসংস্থানের দিকে দাবিত হচ্ছে।
ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ ধরছে জেলেদের এমন অভিযোগের বিষয়ে অপু সাহা কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এটি নিয়ে কাজ চলছে তবে আমাদের দেশের জলসীমানায় অন্যদেশের যদি কেউ মাছ শিকারে আসে তা সম্পূর্ণ অবৈধ এটা ঠেকাতে আমাদের কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবসময় তৎপর রয়েছে।
কলাপাড়ায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মোট ৩০ হাজারের অধিক জেলে রয়েছে যাদের বেশিরভাগ পরিবারই পুরোপুরি নির্ভরশীল এই পেশায়। এসব পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে টেকসই বিকল্প কর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকছে সরকার এমনটাই জানিয়েছেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।
এমআরআর/এএসএম