দেশে ফিরলেন সেই পর্যটক, বর্ণনা নিয়ে ধোঁয়াশা
ঘটনার বর্ণনা দেন ফিরোজ সিকদার
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে গোসলে নেমে নিখোঁজ হওয়া ফিরোজ সিকদার (২৭) ভারতের চেন্নাই থেকে দেশে ফিরেছেন। সোমবার (৬ জুন) বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশের পরই তাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।
মঙ্গলবার (৭ জুন) সকালে পটুয়াখালীর কলাপড়া উপজেলার মহিপুর থানায় এনে ফিরোজকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুপুরে সাংবাদিকদের কাছে নিখোঁজ, উদ্ধার এবং দেশে ফিরে আসার বিষয়ে বর্ণনা দেন তিনি।
ফিরোজ বলেন, ‘২৭ মে আমরা সাতজন কুয়াকাটা ঘুরতে আসি। এদের মধ্যে ছয়জন সমুদ্রে গোসলে নামি, একজন তীরে বসা ছিল। হঠাৎ একটি বড় ঢেউ এসে আমাকে নিয়ে যায়। পায়ে মাটি না পেয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। এরমধ্যে আরেকটি ঢেউ এসে আমাকে আরও গভীরে নিয়ে যায়। এরপর আমি আর কোনো লোকজন দেখতে পারছিলাম না। হঠাৎ একটা কলাগাছ ভাসমান অবস্থায় পাই। গাছটি শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু সময় প্রচণ্ড বাতাসে আমি আরও গভীরে যেতে থাকি। অনেক স্রোতের কারণে আমি দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। পানি লবণাক্ত হওয়ায় গলা দিয়ে নামছিল না। শরীর এত ক্লান্ত হয়েছে যে কলাগাছ ধরে রাখার মত শক্তিও মনে হচ্ছে আমার শরীরে নেই। এমন করতে করতে দেখি সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। পরে দেখি একটি বাতি দেখা যাচ্ছে। মনে করেছি আমি কিনারে। স্রোত আমাকে বাতির দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।’
ফিরোজ আরও বলেন, ‘কিছুটা কাছে গিয়ে দেখি একটি মাছ ধরার বোট। স্রোতে বোটের সঙ্গে ধাক্কা খাই। ক্লান্ত শরীরে ডাকাডাকির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। হাত দিয়ে ইশারা দিলেও কেউ দেখছিল না। কিছু সময় পর লাইট মেরে আমাকে দেখতে পায় জেলেরা। একটি বোটে আমাকে তোলার পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। দু-তিন ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরে। জেলেরা আমাকে নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করে। কিছুই বলতে পারিনি। রাতের খাবার দিলে খাবার খাই আমি।’
‘সকালে কয়েকজন জেলে আমার কাছে বসে আবারও নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করেন। আমি তাদের পুরো ঘটনা বলি। বিকেলে জেলেরা নৌবাহিনীর একটি জাহাজে আমাকে তুলে দেয়। নৌবাহিনীর লোকজন অনেককিছু জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু তাদের কথা কিছু বুঝিনাই। সেখান থেকে পাঁচ-ছয়দিন তারা শিপ চালিয়ে ঘাটে আসে। তাদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারি এটা চেন্নাই। তাদের দেওয়া খাবার খেতে না পেরে শুধু পানি পান করেই ছিলাম।’ যোগ করেন ফিরোজ।
তিনি বলেন, ‘নৌবাহিনীর লোকজন আমাকে ৫ জুন প্লেনে কলকাতা পাঠিয়েছে। তবে প্লেনের টিকিট আমার হাতে দেয়নি। পরে কলকাতা থেকে আমাকে সেখানকার প্রশাসন এসে নিয়ে যায়। রাতে তাদের সঙ্গে থাকি। ৬ জুন সকালে তারা আমাকে ট্রেনের টিকিট, একটি কাগজ ও ৬ হাজার টাকা হাতে দেয়। কাগজে একটি স্বাক্ষর নেন তারা। আমাকে জিপে তারা স্টেশনে নিয়ে যান। ট্রেনে উঠিয়ে বলেন, স্টেশনে ট্রেন থামলে তুমি নামবে না। ট্রেন থামার পরে আমি বসেছিলাম। কতক্ষণ পরে এক ব্যক্তি এসে আমাকে নিয়ে যান। একটি সিনজিচালিত অটোরিকশায় উঠিয়ে দেন তিনি। সিএনজি পেট্রাপোল বন্দরে গিয়ে থামায়। সেখানে এক কর্মকর্তাকে পকেটে থাকা কাগজটা দিই। সে কাগজে একটি সিল দিয়ে আমাকে যেতে বলেন। বাংলাদেশ বর্ডারে ঢুকে পুলিশ চেকপোস্ট দিয়ে ভেতরে আসি। কিছুদূর যাওয়ার পর পুলিশ আমাকে আটকে পাসপোর্টের বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। পাসপোর্ট নেই জানালে তারা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যায়। আমি তাকে সব ঘটনা বলি। পরে তিনি আমাকে বেনাপোল পোর্ট থানায় পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে আজ মহিপুরে আসি।’

তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও সিম পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ফিরোজ বলেন, ‘আমাকে যখন নৌবাহিনীর লোকজন ঘাটে আনে তখন তাদের দেওয়া দুই হাজার টাকা দিয়ে মোবাইল কিনেছি। সেখানকার এক ব্যক্তির নামে সিম নেই। দেশে আসার আগে পেট্রাপোল বন্দরের লোকজন কাগজপত্র ও সিম রেখে মোবাইল দিয়ে দেয়।’
এর আগে নিখোঁজের নবম দিনে ৪ জুন ভারতের চেন্নাই থেকে ফিরোজ তার ভাইকে ফোন করে জানিয়েছেন তিনি চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এমন তথ্য গণমাধ্যমকে ও পুলিশকে নিশ্চিত করেছিলেন তার ভাই মাসুম সিকদার।
তবে তিনি ওখানে কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন জানতে চাইলে ফিরোজ বলেন, ‘আমার কোনো চিকিৎসা লাগেনি। তাই কোনো হাসপাতালে ছিলাম না।’
এদিকে ফিরোজ কলাগাছের ওপর ভর করে ভারতের সীমানায় প্রবেশ, অল্প সময়ে ভারতের চেন্নাই থেকে দেশে প্রবেশ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। তাদের দাবি, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রে ডুবে কিংবা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের বেশিরভাগই ১২-৭২ ঘণ্টার মধ্যে তীরে ভেসে এসেছে। আবার যারা নিখোঁজ হয় পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদেরও বছরের পরে বছর জেল খেটে আইনি বাঁধা পেরিয়ে দেশে আসতে হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে জেলে পেশায় থাকা আশার আলো সমবায়ী সমিতির সভাপতি নিজাম শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে ফিরোজকে যেভাবে দেখা যাচ্ছে এটা সাগরে পড়ে ৭-৮ ঘণ্টা ভেসে থাকা মানুষের মতো না। কারণ সাত-আট ঘণ্টা সমুদ্রের নোনা পানিতে ভেসে থাকলে তার হাত-পা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়ার রং পরিবর্তন ও চামড়া খুলে- ফেটে যাওয়াসহ অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। কিন্তু তার মধ্যে এমন কিছু নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে সমুদ্রের যে অবস্থা তাতে কোনো কিছুর সহায়তায় জোয়ারে একজন মানুষকে ছয়-সাত ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে নিতে পারে। তবে ভারতের সীমানায় পৌঁছানোটা সম্পূর্ণ অসম্ভব।’
কুয়াকাটা ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কেএম বাচ্চু জাগো নিউজকে বলেন, ‘কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে নিখোঁজের পরে বর্তমানে সে যেভাবে বর্ণনা দিচ্ছে এটা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ বানোয়াট মনে হচ্ছে। কেউ ব্যক্তিগত কারণে যদি নাটক সাজিয়ে কুয়াকাটাকে ছোট করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমাদের দাবি থাকবে প্রশাসন যেন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে।’
বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ইন্সপেক্টর মো. ইলিয়াস জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাকে বর্ডার এলাকায় পাওয়ায় পর তার পরিবার জানায় তার নামে মহিপুর থানায় একটি নিখোঁজ সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। তাই মহিপুর থানার ওসির সঙ্গে কথা বলি। পরে একটি লিখিত দিয়ে তাকে পরিবারের হেফাজতে মহিপুর থানায় পাঠাই।’
মহিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের জাগো নিউজকে বলেন, ‘সোমবার দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশ ইন্সপেক্টর আমাকে ফোন করে নিখোঁজ ফিরোজের জিডি সম্পর্কে জানতে চাই। আমি ঘটনা তাকে খুলে বলি। পরবর্তীতে বেনাপোল পোর্ট থানার মাধ্যমে ফিরোজকে তার পরিবার আজকে আমার কাছে নিয়ে আসে। আজকে তার বর্ণনায় কিছুটা গোলমাল মনে হচ্ছে। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পরবর্তীতে আইনানুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
২৭ মে কুয়াকাটা সৈকতে ঘুরতে এসে বন্ধুদের সঙ্গে গোসলে নেমে নিখোঁজ হন ফিরোজ সিকদার নামে এ পর্যটক। ফিরোজ পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়নের মৃত্যু মিলন সিকদারের ছেলে।
আসাদুজ্জামান মিরাজ/এসজে/এএসএম