ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

পর্যটক টানছে নাইক্ষ্যংছড়ির উপবন পর্যটন লেক

সায়ীদ আলমগীর | নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ফিরে | প্রকাশিত: ০৫:১৩ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২৩

যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড় ঘেরা উপবন পর্যটন লেকে পর্যটক উপস্থিতি বাড়ছে। ঝুলন্ত সেতু, কারুকার্যময় বসার স্থান ও অনুমতিক্রমে মাছ ধরার ব্যবস্থার পাশাপাশি ছোট-বড় সবার বিনোদনের ব্যবস্থা থাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশে পিকনিকের জন্য উপবন পর্যটন লেককেই বেছে নিচ্ছেন ভ্রমণপ্রেমীরা। কাজে ডুবে থাকা নানা-পেশার মানুষও বিকেল হলেই এ পর্যটন কেন্দ্রে ভিড় জমাচ্ছেন। এতে বেচাকেনা বাড়ায় খুশি স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয় বাসিন্দা পরিবেশকর্মী নেজাম উদ্দিনের জানান, আশির দশকেও পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি একধরনের যোগাযোগহীন ভয়মাখা জায়গা ছিল। কিন্তু মতিউর রহমান নামের তৎকালীন এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সৃষ্টিশীলতায় গড়ে ওঠে নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যটন উপবন লেক। তিনি প্রকৃতির উপহার পাহাড়ের চারপাশে জলকে কেন্দ্র করে স্থানটিকে উপভোগ্য করার উদ্যোগ নেন। স্থাপন করেন ঝুলন্ত সাঁকো। এরপরই স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমীরা সেখানে ঘুরতে আসা শুরু করেন।

jagonews24

ধীরে ধীরে লেকটি সম্পর্কে প্রচারণা পায়। আশপাশের উপজেলাগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন পিকনিকের জন্য স্থানটি বেছে নেওয়া শুরু করেন। যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হতে থাকলে লেকে লোকসমাগমও বাড়তে থাকে। শীত মৌসুমে লোকজন বেশি আসে লেকে। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার পর্যটকে ঠাঁসা থাকছে উপবন পর্যটন লেক এলাকা। রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের মতো ঝুলন্ত সাঁকোটি আনন্দ দেয় ভ্রমণপিয়াসীদের। মাছ শিকার যাদের নেশা তারাও এখানে বড়শি ফেলে বিনোদন নিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: চলতি বছরই রেল যাবে কক্সবাজার, বদলে যাবে পর্যটন

পার্বত্য বান্দরবানের সর্বদক্ষিণের সীমান্ত উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ি। এর চারপাশে ঘিরে আছে পর্যটন জেলা কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফ। কক্সবাজার সদর থেকে ৩৫ আর রামু সদর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরত্বে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর। এ কারণে কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, উখিয়া, টেকনাফ, পেকুয়া ও কুতুবদিয়া এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া থেকেও প্রকৃতিপ্রেমীরা সবুজ অরণ্যে ঘেরা লেকের সৌন্দর্য দেখতে ছুটে যান।

কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামু চা-বাগান এলাকা দিয়ে পূর্ব দিকে চলে যাওয়া সড়কে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর। সড়কটি প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা রামু উপজেলার দখলে। বাঁকখালী নদী পার হয়ে জারুলিয়াছড়ি বেইলি সেতু এলাকা হতেই নাইক্ষ্যংছড়ি সীমানা শুরু। আঁকাবাঁকা দেড় কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলে সামনে পড়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তা পেছনে ফেলে দুইশ গজ গেলে ডানপাশের উপসড়ক দিয়েই যেতে হয় উপবন লেকে। মিনিট পাঁচেক গেলেই কাঙ্ক্ষিত লেকটি পাওয়া যায়। কক্সবাজার সদর, রামু বা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে লেকে ঘুরে আসা যাবে।

jagonews24

আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে উপরে উঠতেই নজরে আসবে পাহাড়ের চূড়ায় ছোট বেশ কয়েকটি ঘর। সড়ক থেকে পর্যটন স্পটে হাতের বাম দিকে তাকালে নজরে আসবে বিশাল জলপ্রপাত। এর একপাশে নজরে আসবে স্থানীয় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ঘর।

আরও পড়ুন: নির্দিষ্ট স্থানের অভাবে বিলীনের পথে কুয়াকাটার শুঁটকিপল্লি

রামু ও কক্সবাজার সদর থেকে লোকাল মিনিবাস বা সিএনজিচালিত ট্যাক্সিতে করেও লেকে আসা যায়। ৩০ টাকা প্রবেশ ফিতে সারাদিন উপবন লেকে অবস্থান করা যায়।

উপবন লেকে গিয়ে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপজেলা থেকে পিকনিকের গাড়ি এসেছে অনেক। সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে উপবন লেকে এসেছেন। পর্যটকদের কেউ দোলনায় দোল খাচ্ছেন, কেউবা লেকের পাড়ে বসে গল্পে মশগুল। আবার কেউ লেকে প্যাডেলে চলা নৌকায় ভ্রমণ করছেন। মেতে আছে শিশুরাও।

jagonews24

নাইক্ষ্যংছড়ির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল জাগো নিউজকে বলেন, স্বাধীনতার আগে বর্তমান লেকের পশ্চিম পাশে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ঝরনা ছিল। ঝরনার পানি সংরক্ষণে ১৯৮৭ সালে দুই পাহাড়ের মাঝখানে কৃত্রিম হ্রদ খনন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল উপজেলা সদরে পানির সমস্যা দূরীকরণ। তৎকালীন ইউএনও মতিউর রহমান এবং উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আমিই এটি বাস্তবায়ন করেছিলাম। এরপর বাঁধ নির্মাণে সহায়তা দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক নাজমুল আলম সিদ্দিকী। তাকে সহযোগিতা দেন বান্দরবান রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেড়িয়ার শাখাওয়াত হোসেন, ব্রিগেড়িয়ার শাহজাহান, নাইক্ষ্যংছড়ি এলজিইডি কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হাকিম। এভাবেই ১৯৯০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের প্রায় ২৫ একর জায়গাজুড়ে লেকের পাহাড়ে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয় উপবন পর্যটন স্পট।

তখন থেকেই উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় পর্যটন স্পটটি রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে আসছে। শুরুতে এটি ‘ইউএনওর গোধা’ বা লেক নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময়ে ঝুলন্ত সাঁকো নির্মাণের পর ‘শৈলশোভা’ লেক নামে পরিচিতি পায়।

স্থানীয় উদ্যোক্তা মুহাম্মদ জলিল বলেন, ‘দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি স্থানটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। তবে উপজেলায় পর্যাপ্ত হোটেল-রেস্তোরাঁ, সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা আধুনিকভাবে গড়ে না ওঠায় পর্যটকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে রয়েছে এলাকাটি।’

আরও পড়ুন: বিশ্বের এই রহস্যময় ৬ স্থানে ঘুরে আসুন সুযোগ পেলেই

আনন্দ ভ্রমণে আসা ঈদগাঁওর আবু বক্কর জাগো নিউজকে বলেন, বনের মাঝে গড়ে তোলা আকাশ বাড়ি, পিকনিকের জন্য ছোট ছোট ঘর, সবুজ অরণ্যঘেঁষে পাহাড় চূড়ার ওপর প্রাকৃতিক হ্রদের এমন দৃষ্টিনন্দন রূপ আমাদের মুগ্ধ করেছে।

jagonews24

স্থানীয় সূত্র জানায়, আশির দশকের পর থেকে কিছু খণ্ড খণ্ড উন্নয়ন হয় পর্যটন লেকের। তবে, সম্প্রতি বিদায়ী ইউএনও সাদিয়া আফরিন কচির হাত ধরে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। এরপরই উপবন পর্যটন স্পট হিসেবে পূর্ণতা পেয়েছে। কিন্তু সারাদিন পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াতে পারলেও থাকার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় দূরের পর্যটকরা রাতযাপন করতে চাইলেও পারেন না। স্থানীয়দের দাবি, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে হোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠলে অর্থনৈতিক কর্মক্ষেত্র গড়ে উঠতো এখানে।

নাইক্ষ্যংছড়ি ইউএনও রোমেন শর্মা বলেন, উপবন পর্যটন স্পটের সৌন্দর্যবর্ধনে করণীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য বেঞ্চ, টেবিল, শিশুদের জন্য দোলনা, পানির ফোয়ারা, ওয়াচ টাওয়ারসহ বেশ কিছু অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। টাওয়ারে উঠে পাহাড়-প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। আরও কিছু পরিকল্পনা আছে, বরাদ্দ পেলে তাতে হাত দেওয়া হবে।

বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন কেন্দ্রে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসন সচেষ্ট রয়েছে।

এসআর/জিকেএস