২৫ বছর ধরে পাহাড়ের গাছ কাটছেন যুবলীগ নেতা
বান্দরবানের লামায় পাড়াবাসীদের জিম্মি করে বিপন্ন প্রজাতির গাছসহ সব ধরনের গাছ কেটে বন উজাড়ের অভিযোগ উঠেছে মোরশেদ আলম চৌধুরী নামের এক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে। প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার লেমুপালং মৌজাবাসীকে জিম্মি করে ২৫ বছর ধরে গাছ কাটছেন তিনি।
মোরশেদ আলম চৌধুরী চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার ম্রো জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ১৩টি পাড়ার এলাকা থেকে ২৫ বছর ধরে নির্বিচারে গাছ কেটে পাচার করছেন মোরশেদ আলম চৌধুরীর লোকজন। প্রতিবাদ করলে হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি ও মাদক মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। এছাড়া গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের হাতে বন্দুক থাকায় ভয়ে পাড়াবাসী কোনো অভিযোগ দেয়নি। এ সুযোগে গাছ কেটে হাতি দিয়ে লোকালয়ে টেনে এনে ট্রাক ভর্তি করে পাচার করছেন তিনি।
সরেজমিনে উপজেলার সরই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড লেমু পালং মৌজার বাক্কা পাড়া, পুরাতন দেওয়ান পাড়াও নতুন দেওয়ান পাড়ার গিয়ে দেখা যায়, পাড়াকেন্দ্র স্কুলের মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কাঠের খণ্ড। কাঠগুলো মোরশেদ আলম চৌধুরীর বলে জানান স্থানীয়রা। সেখানে সেগুন, করইসহ বিপন্ন প্রজাতির গোদা, গুটগুটিয়া, জলপাই, জারুল, চাপালিশ, হারগাছা, গর্জন, রংগাছও রয়েছে।
নতুন দেওয়ান পাড়ার বাসিন্দা মেন প্রে ম্রো জানান, মৌজায় মাংলাই পাড়া, বাক্কা পাড়া, নতুন দেওয়ান পাড়া, পুরাতন দেওয়ান পাড়া, লোহাঝিড়ি পাড়া, চরকিয়া পাড়া, চালা পাড়া, পালং মূখ পাড়া, তংপ্রে পাড়া, কাপ্রু পাড়া, আমতলী পাড়া, বেঙ পাড়া, লাঙ্গি পাড়ার লোকজন নিজেদের রোপণ করা কোনো গাছও বিক্রি করতে পারেন না। বাড়িঘর তৈরি করার জন্য বন থেকে গাছ কাটতে চাইলে মোরশেদ আলম চৌধুরীর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়।
পুরাতন দেওয়ান পাড়ার কার্বারি চংরেং ম্রো জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে ১৩টি পাড়ার লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছেন মেরশেদ আলম চৌধুরী। নিজেদের রোপণ করা গাছ বিক্রি করতে চাইলে বাজার মূল্য থেকে অর্ধেক দামে তাদের কাছে বিক্রি করতে হয়।
হাতির মাহুতের সহকারী মো. রেজাউল করিম জানান, ইউসুফ বাহাদুর নামের হাতি দিয়ে লেমুপালং এলাকায় চালতা খালে গাছ টানা হচ্ছে। হাতির মালিক সিলেটের মোমেন কোম্পানি। হাতি দৈনিক সাড়ে চার হাজার টাকা ভাড়ায় গাছ টানে। প্রতি সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করতে পারে। হাতিটি প্রতি ট্রিপ ২০ ফুট গাছ দৈনিক চারবার টানতে পারে।

এ বিষয়ে মোরশেদ আলম চৌধুরীর ম্যানেজার মো. রফিক বলেন, ১২ বছর ধরে চাকরি করি। গাছ কাটা, শ্রমিক পরিচালনাসহ সব কিছুই দেখভাল করি। কয়েকদিন আগে মোরশেদ আলম চৌধুরী হজ্বে গেছেন।
তিনি আরও জানান, মোরশেদ আলম চৌধুরী এলাকার হেডম্যান ও পাড়াবাসী থেকে গাছের বাগান কিনেন। বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে জোতপারমিত করে হাতি দিয়ে গাছ টানছেন তিনি। কালাপাহাড় চিম্বুক, পশ্চিমে পালং খাল, উত্তরে ওপর শীল ঝিড়ি, দক্ষিণে বমু খাল লুলেং মৌজা সীমানা চৌহদ্দি হিসেব করে মৌজার জায়গা হেডম্যান সারা জীবনের জন্য বিক্রি করেছেন।
লেমু পালং মৌজার হেডম্যান কাইং ওয়াই ম্রো জানান, মোরশেদ আলম চৌধুরী নাকি আমার মৃত হেডম্যান বাবার কাছ থেকে মৌজার বন কিনেছেন। সেজন্য আগামী ৩০ বছর গাছ কাটবেন, দালিলিক প্রমাণ দেখাতে বললেও দেখাতে পারেন না। প্রতিবাদ করলে নিজের কর্মচারীকে বাদী করে বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানি করেন।
এ বিষয়ে মোরশেদ আলম চৌধুরীর ভাই খোরশেদ আলম চৌধুরী জানান, মোরশেদ আলম চৌধুরী দেশের বাইরে রয়েছেন। কে কি করছে সেটি আমার জানা নেই।
বান্দরবান জেলা হেডম্যান কারবারি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ও হেডম্যান হ্লা থোয়াই হ্রী মারমা বলেন, মৌজা দেখভালের দায়িত্ব হেডম্যানের। মৌজার বন, গাছ কোনোমতে একজন হেডম্যান বিক্রি করতে পারেন না। এক কথায় মৌজার যৌথ সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ অবৈধ।
লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরিফুল হক বেলাল জানান, বন উজাড় করে হাতি দিয়ে গাছ পাচার সম্পর্কে জানা ছিলনা। তবে ডলুছড়ি রেঞ্জে কর্মরতদের অভিযান পরিচালনা করে আইনগত পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার জানান, বন থেকে হাতি দিয়ে গাছ পাচার সম্পর্কে অবগত নই। খোঁজ-খবর নিয়ে গাছপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নয়ন চক্রবর্তী/আরএইচ/এএসএম