ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

গৃহযুদ্ধে ইয়েমেনে আটকা

১৬ বছর পর দেশে ফিরলেন পরিবারের কাছে ‘মৃত’ ছেলে

আয়শা সিদ্দিকা আকাশী | প্রকাশিত: ০৮:৪৬ পিএম, ২৪ মে ২০২৩

সাখাওয়াত হোসেন মামুন। বাবা মো. ফরিদ হোসেন। বাবা চাকরি করতেন আনসার এডজুডেন্ট ব্যাটালিয়ন অফিসার পদে। দুই বোন এক ভাই। পরিবারে কোনো অভাব ছিল না। ছেলে মামুনকে পড়াশোনার জন্য ভারতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে বেশিদিন পড়াশুনা না করে চলে আসেন দেশে। ইচ্ছা হয় বিদেশে যাওয়ার। বাবা-মা কিছুতেই বিদেশ পাঠাবেন না। কিন্তু একমাত্র ছেলের আবদারের কাছে হেরে গিয়ে তার ইচ্ছামতো ২০০৭ সালে টুরিস্ট ভিসায় পাঠান ইয়েমেনে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর অন্য দেশে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে প্রথমে একটি কোম্পানিতে ভালো কাজ পাওয়ায় থেকে যান তিনি। কয়েক বছর যেতেই ইয়েমেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধে তিনি দেশে আসতে চাইলেও নানা কারণে আসতে পারেননি। থেকে যেতে হয় তাকে।
এরপর ওই কোম্পানির মালিক মারা যাওয়ার পর তাকে বিক্রি করা হয় অন্য একটি কোম্পানিতে। সেখানে তার পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্র জমা দিয়ে কাজ নিতে হন। একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে মালিকের অমানবিক অত্যাচারে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন মামুন। পরিবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এভাবে প্রায় ৫ বছর সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন মামুন। দেশে তার বাবা-মা, বোনসহ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ভেবে নেন যুদ্ধে হয়তো মারা গেছেন তিনি। সেই শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তার বাবা। ২০১৬ সালে মারা যান মামুনের বাবা। দীর্ঘ বছর পর হঠাৎ একদিন মামুন তার মা শাহনুর বেগমের মোবাইলে ফোন দেন। হঠাৎ ফোনে ছেলের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে আনন্দে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। তার ছেলে বেঁচে আছে, এর থেকে আনন্দ আর কী হতে পারে। আবার যোগাযোগ বিছিন্ন। এরপর কয়েক মাস পর পর ফোন আসে ছেলের। এভাবেই চলে যায় ১৬ বছর।

কিন্তু পাসপোর্ট নেই। মালিক তাকে পাসপোর্ট ফেরত দেন না। তিনি কিভাবে দেশে আসবেন। তাছাড়া মানসিকভাবেও অসুস্থ ছিলেন মামুন। যখন একটু সুস্থ হলেন তখন দেশে যোগাযোগ করেন। আবার যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন যোগাযোগ বন্ধ। এদিকে তার পরিবার নানান জায়গায় ছেলেকে ফেরত আনার চেষ্টা করেন। পরিশেষে এক ব্যক্তির সহযোগিতায় একটি সংস্থার মাধ্যমে ১৭ মে সকালে ইয়েমেন থেকে নিজ দেশে ফেরেন মামুন।

মামুনের ফিরে আসার খবরে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশী তাদের মাদারীপুর শহরের ২নং শকুনি এলাকার ভাড়াবাসায় ভীড় করছেন।

এ ব্যাপারে সাখাওয়াত হোসেন মামুনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ইয়েমেনে যাওয়ার পর প্রথম মালিক অনেক ভালো ছিলেন। সেখানে কয়েক বছর কাজ করেছি। এরপর গৃহযুদ্ধ শুরু হলে গ্যাস কোম্পানির কারখানা বোমা হামলায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর মালিকও মারা গেলে আমাকে অন্য একটি কোম্পানিতে কাজ দেওয়া হয়। সেই মালিক আমার পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্র নিয়ে নেন। ওই দেশে মানুষ বেচা-কেনা হয়। আমাকেও বহুবার বেচা হয়েছে। মালিক সারাদিন কাজ করাতো। টাকা দিত না। কাজ না করলে অমানবিকভাবে মারধর করতো।

তিনি বলেন, কাজ করতে করতে আমার হাত ও পায়ের সব নখ উঠে গেছে। এমনকি হাতে বড় বড় ফোসকা পড়তো। বুকের উপর লাথি মারতো। এভাবে তারা আমাকে মারধর করতো। কিন্তু দেশে আসবো, তার উপায় নেই। কারণ আমার কাছে পাসপোর্ট ছিল না। পাসপোর্ট চাইলে তারা পাসপোর্ট দিত না। তাই পালিয়ে অন্য জায়গায় কাজে যাই। সেখানেও একই অবস্থা। এদিকে যুদ্ধ চলছে। বিদ্রোহীরা কয়েকবার আমাকে ধরে নিয়েও গিয়েছিল। যখন আমার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছে আমি ইয়েমেনের মানুষ না, তখন ছেড়ে দিয়েছে। এসব কারণে আমার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে অনেকদিন রাস্তায় থেকেছি, খেয়ে না খেয়ে থেকেছি। আবার যখন সুস্থ হতাম, তখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করেছি। দেশে মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।

তিনি আরও বলেন, আমি ইয়েমেনের সানা এয়ারলাইন্সে ক্লিনারের কাজ করেছি কিছুদিন। একদিন গৃহযুদ্ধে এয়ারপোর্টটি ধ্বংস হয়ে হয়। তখন সেখান থেকে চলে যাই দমত নামের একটি গ্রামে। সেখানে একটি গ্যাস কোম্পানিতে কাজ করি। সেখানে একটি দুর্গের মতো ঘরে থাকতাম। সেই ঘরটি যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর একটি বিল্ডিংয়ের ছাদে থাকতাম। একদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে ঘরের বাইরে গোসল করতে যাই, ফিরে আসার সময় জানতে পারি ওই বিল্ডিং বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছে। সেসময় আমাকে বিদ্রোহীরা ধরে নিয়ে যায়। তখন আমি যেখানে কাজ করতাম সেই কোম্পানির মালিক মো. মাহদী আল আইদী আমাকে তিনদিন পর ছাড়িয়ে আনেন।

কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে মামুন বলেন, এরপর ইয়েমেনের এশমা শহরে চলে আসি। সেখানে কিছুদিন কাজ করি। হঠাৎ জানতে পারি এখানে হামলা হতে পারে। তাই আমরা কয়েকজন মিলে হুসনা পাহাড়ে আশ্রয় নিই। সেখানে থাকা অবস্থায় সাপে কামড় দেয়। তখন আমি পাহাড় থেকে ছুটে মালিকের বাসায় এসে তাকে ঘটনাটি বলি। পরে মালিক আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করান। পর পর তিনটি হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলে এবং আমি তিনদিন অজ্ঞান হয়ে থাকি। পরে আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে যাই। আবার শুরু হয় আমার জীবন সংগ্রাম। একটি মোবাইলও ছিল না আমার। শুধুমাত্র মায়ের নম্বরটা মুখস্ত ছিল। তবে মাঝে মধ্যে মায়ের নম্বরও ভুলে যেতাম। আজ যে দেশে ফিরতে পেরেছি, এটাই আমার জন্য পরম আনন্দ। মনে হচ্ছে যেন আমি নতুন জীবন পেলাম।

তিনি বলেন, আল্লাহ যেন কোনো মানুষকে এমন পরিস্থিতিতে না ফেলেন। প্রবাস জীবন খুব কষ্টের। জীবনে আর কোনোদিন বিদেশে যাব না। যতদিন বাঁচি পরিবারের সঙ্গেই থাকবো। আমার শোকে বাবা মারা গেছেন। এরচেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে।

মামুনের ছোট বোন ফারজানা আক্তার মুন্নি বলেন, আমার একমাত্র ভাইকে ফিরে পাবো তা কোনোদিন ভাবিনি। এটা যে কত আনন্দের তা কাউকে বোঝানো যাবে না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করেন (নাম মনে নেই) তার শ্যালক সায়িদ প্রায় ১৫ বছর তুরস্কে আটকা পড়েছিলেন। সায়িদ তুরস্ক থেকে ইয়েমেনে আসেন। সেখান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মামুন নামে একজনের কাছে আশ্রয় নেন সায়িদ। ওই মামুনের সঙ্গে আমার ভাই মামুনের যোগাযোগ ছিল। ওই মামুন যখন ইয়েমেন যান তখন আমার ভাই তাকে সহযোগিতা করেছেন। বর্তমানে ওই মামুন ইয়েমেনে একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন। মামুনের সহযোগিতায় সায়িদ তার কাগজপত্র ঢাকায় তার দুলাভাইয়ের কাছে পাঠান। তখন সেই কাগজপত্রের মধ্যে আমার ভাই এর ছবি ভুল করে চলে আসে। তখন সায়িদের দুলাভাই এই ছবি কার জানতে চান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মামুন তখন তাকে আমার ভাই মামুনের সব ঘটনা খুলে বলেন। সব শুনে তিনি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে আমার নম্বর নেন। তারপর তার কথা মতো আমার ভাইয়ের জন্মসনদ, নাগরিক সনদ ও পাসপোর্টের ফটোকপি (দেশে ছিল) পাঠাই। তিনিই সব ব্যবস্থা করেন। আমার ভাইয়ের মানসিক সমস্যা থাকায় দেশে আসার আগে পাঁচ মাস মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। সেখানে চিকিৎসা শেষে মানসিকভাবে একটু সুস্থ হলেই ১৭ মে সকালে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। ইউএনডিপির সহযোগিতায় চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরতে পেরেছেন আমার ভাই।

মামুনের মা শাহানুর বেগম বলেন, বিদেশে আমার ছেলে এত কষ্ট করেছে, তা আর মনে করতে চাই না। মনে করলেই বুক ফেটে কান্না আসে। আমার ছেলে আমার কাছে ফিরে এসেছে, এটাই বড় কথা। তবে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ইউএনডিপিসহ সকলকে। যারা আমার ছেলের আসার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন।

এফএ/জিকেএস