রাঙামাটিতে নড়বড়ে অবস্থানে বিএনপির
অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাঙামাটি জেলা বিএনপির অবস্থান বর্তমানে নড়বড়ে হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে দলটির সার্বিক অবস্থান সম্পর্কে পর্যবেক্ষণসহ স্থানীয় অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে পরস্পরবিরোধী দুটি গ্রুপের চরম বৈরীতার মধ্যে ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়েছে জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন। সম্মেলনে পুনর্গঠন করা হয় জেলা বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটি।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ কাউন্সিলে জেলা বিএনপির নতুন কমিটিতে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম সভাপতি এবং সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক দীপন তালুকদার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। সাবেক সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান পুনরায় প্রার্থী হলেও কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে প্রহসনমূলক দাবি করে ওই নির্বাচন বর্জন করেন।
এ বিষয়ে আলাপকালে অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান বলেন, বিতর্কিত এ কমিটি সম্পর্কে কেন্দ্রে অভিযোগ থাকায় এখনও অনুমোদিত হয়নি। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে যোগ দিচ্ছেন জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা।
দীপেন দেওয়ানসহ তার নেতৃত্বাধীন গ্রুপের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, ওই কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়নি। তাই নির্বাচন বর্জন করে তা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা। কিন্তু অপরপক্ষ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কতিপয় স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে যোগসাজশ করে নানা ষড়যন্ত্র এবং কালো টাকা ও পেশী শক্তির জোরে পদ-পদবি দখলে নিতে সক্ষম হয়েছে। অথচ দলে তাদের যেমনি ছিল না গ্রহণযোগ্যতা- তেমনি দলের সাংগঠনিক ভিত্তি গঠনের পেছনেও ছিল না তেমন একটা উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা।
দীপেন দেওয়ান বলেন, তিনি যোগদানের পর থেকে জিয়াউর রহমানের ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’ বিশ্বাসী হয়ে এখানকার পাহাড়ি বাঙালি সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করায় জেলা বিএনপিকে দ্রুত সাংগঠনিকভাবে জোরদারে সক্ষম হয়েছেন। দলে দলে বিএনপিতে যোগ দেন পাহাড়ি জনগণ। কিন্তু এখানকার কতিপয় দলীয় নেতা ‘পাহাড়িমুক্ত বিএনপি চাই’ ঘৃন্যতম সাম্প্রদায়িকতার কারণে এবং সরকারি দলের সঙ্গে যোগসাজশ করে টেন্ডারবাজিসহ দলীয় স্বার্থ ও সংগঠন পরিপন্থীমূলক নানা কর্মকাণ্ডে অনেক সাধারণ নেতাকর্মীকে নিস্ক্রিয়, দলত্যাগসহ দল থেকে ছিটকে পড়তে বাধ্য হতে হচ্ছে।
দলীয় সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে জেলা যুগ্ম-জজ থেকে ইস্তফা দিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেন অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান। সেই সময়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে উপমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা রাঙামাটির এমপি মণি স্বপন দেওয়ানের পরিবর্তে ২৯৯ পার্বত্য রাঙামাটি আসনে দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় দীপেন দেওয়ানকে।
অপরদিকে মনোনয়ন না পেয়ে দল থেকে বেরিয়ে এলডিপিতে চলে যান তৎকালীন পার্বত্য উপমন্ত্রী মণি স্বপন দেওয়ান। একই সময়ে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে দেশের বাড়ি সিলেটে চলে যান দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্বে থাকা তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন আহমেদ। এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে দলের হাল ধরেন দীপেন দেওয়ান। জরুরি অবস্থার মধ্যেও জেলা, উপজেলা থেকে শুরু করে তৃণমূলে ভেতরে ভেতরে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করে তোলেন তিনি। দীপেন দেওয়ানের নেতৃত্বে সুসংগঠিত হন উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি দীপেন দেওয়ানের হাত ধরে দলে দলে বিএনপিতে যোগদান করেন বহু পাহাড়ি নেতাকর্মী।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনি জটিলতার কারণে দীপেন দেওয়ান প্রার্থী হতে না পারায় রাঙ্গামাটি আসনে তার স্ত্রী মৈত্রী চাকমাকে মনোনয়ন দেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ২০০৯ সালের ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান। দীপেন দেওয়ানের বাবা স্বর্গীয় সুবিমল দেওয়ান ছিলেন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা।
২০১৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নেয়। পদ-পদবি নিয়ে মরিয়া হয়ে ওঠেন নেতাকর্মীরা। কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে সভাপতি পদে দুই প্রার্থী অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান এবং মো. শাহ আলম নেতৃত্বাধীন পরস্পরবিরোধী দুটি গ্রুপ। কাউন্সিলে শাহ আলম গ্রুপ জয়ী হলেও বিভিন্ন অনিয়ম, কারচুপি ও প্রহসনের অভিযোগ তুলে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বরাবরে ১০৮ জনের স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র দিয়েছে দীপেন দেওয়ানের নেতৃত্বাধীন অপর গ্রুপের নেতাকর্মীরা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, শাহ আলমসহ কতিপয় নেতা সরকারি দলের সঙ্গে টেন্ডারবাজিতে জড়িত। ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘দেশ বাঁচাও, অর্থনীতি বাঁচাও’ কর্মসূচিতে প্রকাশ্য যোগ দিয়ে শাহ আলমসহ তার নেতৃত্বে কতিপয় নেতা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সাংগঠনিক পরিপন্থীমূলক অপরাধ করেছেন, যা কঠোর শাস্তিযোগ্য।
এদিকে শাহ আলমের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ ‘পাহাড়িমুক্ত বিএনপি চাই’ এবং দীপেন দেওয়ানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ ‘টেন্ডারবাজ-দালালমুক্ত বিএনপি চাই’ দাবির রেশ দুটি গ্রুপেই এখনও রয়ে গেছে বলে প্রতীয়মান। বিরোধের কারণে নতুন কমিটির অনুমোদন নিয়ে বিলম্ব ঘটছে বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্রটি।
সূত্রটির মতে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অবসান এখনও হয়নি। জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শাহ আলম জেলায় দলীয় সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী বলে দাবি করলেও কোন্দলে দলীয় অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে বলে মন্তব্য একাংশের নেতাকর্মীদের। ফলে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভূট্টোসহ অন্য কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটেছে বলে মনে করছেন তারা।
আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও ভরাডুবির আশঙ্কা করছেন নেতাকর্মীদের অনেকে। সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ দলে যোগ্য প্রার্থী না থাকায় জেলার দশ উপজেলার মধ্যে পাঁচটি উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদে কোনো প্রার্থী দিতে পারছে না বিএনপি। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে যোগ দিচ্ছেন রাঙামাটি জেলা বিএনপির ২৬ কাউন্সিলর ও ১৫০ ডেলিগেট।
জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, সম্মেলনে গঠিত নতুন জেলা কমিটির অচিরেই অনুমোদন আসবে। বর্তমানে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থান ভালো। এ কারণে দলে কোনো অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। জেলা থেকে কাউন্সিলর এবং ডেলিগেটরা কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে যোগ দিতে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
সুশীল প্রসাদ চাকমা/এফএ/এমএস