মেঘনায় ট্রলারডুবি
নিখোঁজদের অপেক্ষায় নদীপাড়ে স্বজনরা
মেঘনা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় ট্রলার ডুবে ছয়জন নিখোঁজের ঘটনায় নদীপাড়ে ভিড় করছেন স্বজন ও স্থানীয়রা। শনিবার (৭ অক্টোবর) সকালে দ্বিতীয় দিনের উদ্ধার অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ভিড় করেন তারা। তাদের একটাই দাবি, জীবিত বা মৃত যে কোনো অবস্থায় ফিরে পেতে চান নিখোঁজদের।
সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, গজারিয়া ফেরিঘাটের পন্টুনে নিখোঁজদের স্বজনসহ স্থানীয়রা ভিড় করছেন। এছাড়া নদীতে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ, নৌপুলিশ, ফায়ার-সার্ভিসের সদস্যরা। বৃষ্টির মধ্যে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হলেও নদীপাড়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন নিখোঁজদের স্বজনরা।
ট্রলার ডুবিতে এখনো নিখোঁজ সাব্বির ও তার ছেলে ইমাদের বাড়ি রংপুর। গজারিয়ায় শ্যালিকার বাড়ি বেড়াতে এসে ছেলেসহ নিখোঁজ হওয়া সাব্বিরকে ফিরে পেতে রংপুর থেকে ছুটে এসেছেন তার ভাই হারুন-উর-রশিদ ও মো. শাহীন।

অশ্রুসিক্ত চোখে নিখোঁজ সাব্বিরের বড় ভাই হারুন-উর-রশিদ বলেন, সাব্বির চার বছর আগে বিয়ে করেছে। তার ছেলে ইমাদের বয়স ২২ মাস। বৃহস্পতিবার সাব্বির আমাকে বলে তার শ্যালিকার বাসায় বেড়াতে যাবে। শুক্রবার শুনি যে ঘুরতে গিয়ে আমার ভাতিজাসহ ও ডুবে গেছে। ১৮ ঘণ্টার বেশি সময় হয়েছে, তাদের খোঁজ নেই। আমার একটাই আকুতি যে কোনো অবস্থায় তাদের উদ্ধার করা হোক। শেষবারের মতো ভাই-ভাতিজাকে দেখতে চাই।
আরও পড়ুন: নদী উত্তাল, যত্রতত্র ড্রেজিংয়ে ব্যাহত তল্লাশি অভিযান
আরেক ভাই মো. শাহীন বলেন, শুক্রবার দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় আমাকে ফোন দিয়েছে আমি জিজ্ঞেস করলাম খেয়েছে কি না। পরে আমাকে জানালো সে রোববার ফিরবে। রাতে শুনি আমার ভাই ডুবে নিখোঁজ। কি থেকে কি হয়ে গেলো। যে বাল্কহেডটির ধাক্কায় ট্রলারটি ডুবে গেলো তাদের বিচার চাই।
এদিকে স্থানীয় উপস্থিত কয়েকজন জানান, যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এরপরে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু পরে আর খবর পাওয়া যায় না। নিয়ম অনুযায়ী বিকেল ৫টার পর কোনো ধরনের বাল্কহেড নদীতে চলার কথা নয়। এরপরও কীভাবে বাল্কহেড চললো, কাদের গাফিলতি সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা।

অন্যদিকে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে নিখোঁজদের মধ্যে সুমনা আক্তার (২৮) নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুপুর ১টার দিকে তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা রমজানবেগ এলাকা সংলগ্ন নদীপাড় থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্টরা। নিহত সুমনা গজারিয়া উপজেলার দক্ষিণ ফুলদি এলাকার মফিজুলের স্ত্রী। তবে এখনো নিখোঁজ সুমনার দুই মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা (৩) ও জান্নাতুল মাওয়া (৭)। নিখোঁজ রয়েছে তাদের পরিবারের আরেক শিশু মারোয়া আক্তার (৯)। তাদের বাড়ি গজারিয়া উপজেলার ফুলদি এলাকায়।
আরও পড়ুন: মায়ের মরদেহ উদ্ধার, খোঁজ মেলেনি দুই মেয়ের
শনিবার সকাল থেকে ঘটনাস্থলসহ আশপাশে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড এবং বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্টরা। রাতে নদীতে না নামতে পারলেও সকাল থেকে নদীর তলদেশে তল্লাশি শুরু করে ডুবরি দল। তবে নদী উত্তাল ও যত্রতত্র ড্রেজিংয়ের কারণে নদীর তলদেশে খাদ তৈরি হওয়ায় তল্লাশি কার্যক্রম ব্যাহত ও বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

কোস্টগার্ডের ডুবরি মো. অপু শেখ বলেন, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস এবং বিআইডব্লিউটিএর মোট তিনটি ডুবরি টিম নদীতে তল্লাশি কার্যক্রম চালাচ্ছে। নদীর কোথাও ৭০ ফিট, কোথাও ৮০ ফিট কোথাও আবার কোথাও ১২০ ফিট গভীর। ড্রেজিংয়ের কারণে কোথাও আবার গভীর খাদ। এতে আমাদের উদ্ধার তৎপরতায় বেগ পেতে হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ ডুবরি মোহাম্মদ মাসুম বলেন, নদীর তলদেশে প্রচুর স্রোত। এছাড়া তলদেশ সমান্তরাল না হওয়ায় সঠিকভাবে নাব্যতা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও গভীর খাদ রয়েছে। এজন্য নদীর তলদেশে গিয়ে তল্লাশি চালানো যাচ্ছে না। তবে আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ট্রলার শনাক্তের বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক (নারায়ণগঞ্জ অঞ্চল) মো. ওবায়দুল করিম খান বলেন, নদীর এক জায়গায় তেল ভাসতে দেখা গেছে। সেখানে ডুবে যাওয়া ট্রলারটি আছে কিনা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে কলাগাছিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হাবিবুল্লাহ জানান, ঘাতক নৌযানটিকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে তবে এখনো সেটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: মেঘনায় ট্রলারডুবিতে মা ও সন্তানসহ নিখোঁজ ৬
শুক্রবার মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার উপজেলার দৌলতপুর থেকে চালকসহ ১২ জন আত্মীয়-স্বজন মিলে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জের সীমান্তবর্তী চর কিশোরগঞ্জ এলাকায় ট্রলারযোগে ঘুরতে আসেন তারা। ঘুরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় ফেরার পথে মেঘনা নদীর মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের সীমান্তবর্তী স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে। রাতে আধারে অবৈধভাবে চলা বাল্কহেডের ধাক্কায় ডুবে যায় ট্রলারটি। স্থানীয়দের সহযোগিতায় চালকসহ সাতজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও নিখোঁজ হয় চার শিশুসহ ছয়জন।
আরাফাত রায়হান সাকিব/জেএস/এএসএম