ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

ভারতে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে পাড়ি দিতে হচ্ছে হাজার কিমি বেশি পথ

নাজমুল হুসাইন | প্রকাশিত: ১১:৫৯ এএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানিতে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ছিল ভারত-বাংলাদেশের বন্দরগুলোর অবকাঠামো দুর্বলতা। চলতি বছর থেকে ভারতের অধিকাংশ স্থলবন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ও দেশটিতে পণ্য অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতায় ভুগছে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত। এসব নিয়ে জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজমুল হুসাইনের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানিতে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক ছুঁয়েছিল কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। পরের পাঁচ বছরের মধ্যে ওই রপ্তানির পরিমাণ দ্বিগুণ করার প্রত্যাশা ছিল খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় সে আশা এখন ‘গুড়েবালি’। এখনো রপ্তানি সেই বিলিয়নের ঘরেই আটকে রয়েছে, বরং আরও কমেছে।

কেন এ অবস্থা? একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আপনি পল্টনের বাসা থেকে নিয়মিত মতিঝিলে অফিস করেন। কিন্তু যেতে হচ্ছে রামপুরা-বাড্ডা হয়ে উত্তরা পর্যন্ত। এরপর উত্তরা স্টেশনে গিয়ে মেট্রোরেলে মিরপুর, ফার্মগেট, শাহবাগ হয়ে তারপর মতিঝিল অফিসে। আপনার দুর্ভোগটা কেমন হবে? নিশ্চয় আপনার প্রতিদিনের এ অফিসযাত্রা তখন জীবনের সবচেয়ে বড় ঝঞ্ঝাট মনে হতে পারে।

ভারতের এ সিদ্ধান্তের পর প্রতিটি কোম্পানি রপ্তানিতে হোঁচট খেয়েছে। সুবিধাজনক বন্দরগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কারণে খরচ ও লিড টাইম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সেটা অনেকে পোষাতে না পেরে রপ্তানি বন্ধ করেছেন।- আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং মাইদুল ইসলাম

আশ্চর্য হলেও সত্যি, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করা কৃষি ও খাদ্যপণ্য এখন ভারতের বাজারে যাচ্ছে এ ধরনের ঝঞ্ঝাটপূর্ণ রুটে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের তিন পাশে ভারতের অবস্থান হলেও শুধু একপাশ দিয়ে পণ্য যাচ্ছে, অন্য দুপাশ বন্ধ।

তৈরি পোশাক ছাড়াও স্থলবন্দর ব্যবহার করে খুব সহজে, কম সময়ে কম পথ পাড়ি দিয়ে কেক, চিপস, বিস্কুট, আসবাব, ড্রিংকস ও প্লাস্টিকপণ্য যেত ভারতে। সরাসরি রুটগুলো ছিল- ঢাকা-বাংলাবান্ধা-শিলিগুড়ি (পশ্চিমবঙ্গ)— দূরত্ব প্রায় ৪৭৫ কিমি, ঢাকা-বুড়িমারী-কোচবিহার (পশ্চিমবঙ্গ)— দূরত্ব প্রায় ৪৫১ কিমি, ঢাকা-আখাউড়া-আগরতলা (ত্রিপুরা)— দূরত্ব প্রায় ১২৮ কিমি, ঢাকা-চাতলাপুর-করিমগঞ্জ (আসাম)— দূরত্ব প্রায় ৩০৮ কিমি, ঢাকা-শেওলা-করিমগঞ্জ (আসাম)— দূরত্ব প্রায় ২৮৮ কিমি এবং ঢাকা-তামাবিল-শিলং (মেঘালয়)-গৌহাটি (আসাম)—দূরত্ব প্রায় ৪৬৮ কিমি।

এখন পাড়ি দিতে হবে

নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে ঘুরে যেতে হবে বেশ লম্বা পথ। অতিরিক্ত পাড়ি দিতে হবে প্রায় চার থেকে ১৫ গুণ বেশি পথ। এখন যদি রপ্তানিকারকরা স্থলপথে পণ্য পরিবহন করতে চান সেক্ষেত্রে ঢাকা-ভোমরা-কলকাতা-শিলিগুড়ি-গৌহাটি-করিমগঞ্জ-আগরতলা (১ হাজার ৯শ কিমি প্রায়) কিংবা ঢাকা-সোনামসজিদ-শিলিগুড়ি-গৌহাটি-করিমগঞ্জ-আগরতলা (প্রায় ১ হাজার ৬শ কিমি প্রায়) হয়ে তবেই পৌঁছাতে হবে।

স্থলবন্দর বন্ধের পরে আমাদের পণ্য পরিবহনের খরচ সাড়ে ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। যেটা সমন্বয় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।- প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল

রপ্তানিকারকরা জানান, বাংলাদেশের হবিগঞ্জে কোনো খাদ্যপণ্যের কারখানা হলে সে পণ্য আগে আগরতলা স্থলপথ হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যেত মাত্র ১৫৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। আর ওই পণ্য শেষ রাজ্য মিজোরাম যেত সর্বোচ্চ ৩৫০ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে। কিন্তু এখন পাড়ি দিতে হচ্ছে হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ।

আরও পড়ুন
পাটপণ্যে ভারতের নিষেধাজ্ঞা রপ্তানিতে তেমন প্রভাব ফেলবে না
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে নতুন নিষেধাজ্ঞা
বাংলাদেশে ভারতের পণ্য রপ্তানি কমেছে ২৮ শতাংশ
ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে অশুল্ক বাধায় খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ

কারণ এখন পশ্চিমবঙ্গের শুধু তিনটি স্থলবন্দর দিয়ে খাদ্যপণ্য রপ্তানির সুযোগ রেখেছে ভারত। যা প্রথমে কলকাতায় ঢুকে এরপর শিলিগুঁড়ি, চিকেন নেক হয়ে আবার সাত রাজ্যে আসছে। এ পথ হাজার কিলোমিটারের বেশি।

চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে নয় ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ভারত। এর মধ্যে ছিল প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। ওই সময়ের পর থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন (এলসিএস)/ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) এবং পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন দিয়ে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের বেনাপোল সংলগ্ন পেট্রাপোল, ভোমরার ঘোজাডাঙ্গা ও হাকিমপুরের হিলি বন্দর দিয়ে চালু রয়েছে।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের পরে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্য ত্রিপুরাসহ ভারতের ওই সাতটি রাজ্যে পণ্য পৌঁছাতে খরচ ও সময় কয়েকগুণ বেড়েছে। চালু থাকা স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো দুর্বলতা রয়েছে। আগের জনপ্রিয় বন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞায় ভারতে খাদ্যপণ্য রপ্তানি মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

এ সিদ্ধান্তের আগে ভারতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কোমলপানীয় রপ্তানি করতো আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব মার্কেটিং মাইদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতের এ সিদ্ধান্তের পর প্রতিটি কোম্পানি রপ্তানিতে হোঁচট খেয়েছে। সুবিধাজনক বন্দরগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কারণে খরচ ও লিড টাইম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সেটা অনেকে পোষাতে না পেরে রপ্তানি বন্ধ করেছেন। আবার বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা ভারতীয় আমদানিকারকদের খরচ বেড়েছে, তারা এখন আগ্রহ কম দেখাচ্ছেন। কারণ তারা কাঙ্ক্ষিত মুনাফা পাচ্ছেন না।’

ভারতের ওই সিদ্ধান্তের পরপরই আমরা তাদের সঙ্গে সচিব পর্যায়ের মিটিংয়ের জন্য অনুরোধ করেছিলাম, তাদের (ভারতের) কাছে সাড়া পাইনি। এরপর চিঠি-পত্র দিয়েছি। সেগুলোর জবাব পেলে পুনরায় কথা বলা যাবে।- বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান

ভারতের বাজারে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্য জনপ্রিয় আসামসহ সাতটি রাজ্যেই। আগে রপ্তানিকারকরা সেই গন্তব্য মাথায় রেখে সীমান্ত নিকটবর্তী বাংলাদেশি এলাকায় গড়েছিলেন তাদের কারখানাও। এ সিদ্ধান্তের পরে এখন তাদের যেতে হচ্ছে পুরো উল্টোপথে। যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও খরচ ও সময় বাড়ছে।

রপ্তানিকারকরা জানান, এখন রপ্তানি পণ্য প্রথমে কলকাতায় নিতে হচ্ছে। এরপর সেখানকার ডিপো থেকে পৌঁছাতে হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যে। দীর্ঘ পথ হওয়ার কারণে সরাসরি পণ্য পরিবহনের সুযোগ কমে গেছে। আবার সুবিধাজনক সময়ে পরিবহনও মিলছে না ভারতে। যার জন্য পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়ছেন অনেকে। সবমিলে আগের চেয়ে রপ্তানি পণ্যের পরিবহন খরচ প্রায় পাঁচগুণ বেড়েছে।

মূলত ভারতের সাতটি রাজ্যের বাজারে ভারতের নিজস্ব পণ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্যেরও আধিক্য ছিল। কারণ ভারতের মূল ভূখণ্ডের কোম্পানিগুলোর চেয়ে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো কম সময় ও খরচে ওইসব এলাকায় পণ্য পৌঁছাতে পারতো। সে সুযোগ বন্ধ করার জন্যই ভারত এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করছেন এ দেশের বেশিরভাগ রপ্তানিকারক।

ভারতের একজন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট দেবাশীষ রায় মোবাইল ফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ধরুন আগে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, মৌলভীবাজারের চাতলাপুর, সিলেটের শেওলা, তামাবিল স্থলবন্দরের মতো ছয়টি বন্দর দিয়ে ভারতের সাতটি রাজ্যে বর্ডার পার করে ১৮ থেকে ২৫ হাজার রুপিতে এক ট্রাক পণ্য দিতে পারতো। যেখানে এখন কলকাতা থেকে শিলিগুঁড়ি হয়ে আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ বা আগরতলায় নিতে প্রায় এক লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে।’

ভারতে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থলবন্দর বন্ধের পরে আমাদের পণ্য পরিবহনের খরচ সাড়ে ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। যেটা সমন্বয় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

গত ছয় মাসেও দেশের এ পণ্য রপ্তানির বড় দুর্ভোগ কমাতে বাংলাদেশের সরকার কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। নিষেধাজ্ঞার পরপরই কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের কিছু কার্যক্রম দেখা দিলেও এখন সেটি স্তিমিত হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতের ওই সিদ্ধান্তের পরপরই আমরা তাদের সঙ্গে সচিব পর্যায়ের মিটিংয়ের জন্য অনুরোধ করেছিলাম, তাদের (ভারতের) কাছে সাড়া পাইনি। এরপর চিঠি-পত্র দিয়েছি। সেগুলোর জবাব পেলে পুনরায় কথা বলা যাবে।’

এনএইচ/এএসএ/এএসএম