ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

ঢালিউডকে ছায়া দেওয়া সালমানের অপমৃত্যু, ঘটনাপরম্পরা

রাসেল মাহমুদ | প্রকাশিত: ০২:০২ পিএম, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

স্মৃতিময় এক ছবি। পরিচালক মালেক আফসারির পেছনে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে তখনকার ঢালিউডের প্রাণপুরুষ সালমান শাহ। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, তারা মাত্রই জানেন, কতটা বিনয়ী এবং সহকর্মী অন্তপ্রাণ ছিলেন ঢালিউড তারকা সালমান শাহ। ঢালিউডকে যেন ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন এই অভিনেতা। আজ (৬ সেপ্টেম্বর) তার অকাল প্রয়াণের ২৯তম বছর।

সালমানের মৃত্যুর পর থেকেই তার মা রাজনীতিবিদ নীলা চৌধুরী বলে আসছিলেন, তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। এত বছর পরও তিনি তার বিশ্বাসে অটল। সালমানের মৃত্যুর পরের বছর ১৮ আগস্ট দৈনিক ভোরের কাগজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নীলা চৌধুরী দৃঢ়ভাবে সেকথা বলেছেন।

সালমান স্মরণে প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক পারভেজ খানের প্রশ্ন ছিল, মেডিকেল বোর্ড দুই দফার ময়না তদন্ত রিপোর্ট, ভিসেরা রিপোর্ট পর্যালোচনা করে আবারো বলেছে সালমান আত্মহত্যা করেছে। জবাবে নীলা চৌধুরী বলেছিলেন, এই বোর্ড এবং বোর্ডের রিপোর্ট আমি বিশ্বাস করি না। বাইরের বিশেষজ্ঞ দিয়ে বোর্ড গঠন করা হোক।

ছেলের আত্মহত্যাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগও ওঠে নীলা চৌধুরীর বিরুদ্ধে। ভোরের কাগজে প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে বর্ণিত রয়েছে –

ঢালিউডকে ছায়া দেওয়া সালমানের অপমৃত্যু, ঘটনাপরম্পরাসালমান শাহ। ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে সালমানের মা নীলা চৌধুরী, ঢাকার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার এ কে আল মামুন, একজন সিনিয়র সাংবাদিক, ক্যান্টনমেন্ট থানায় তৎকালীন ওসি শাহাবুদ্দিন মিলে এই ‘নাটক’ তৈরি করেছে। উদ্দেশ্য তিনটি। এক, ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান ডিসি সৈয়দ বজলুল করিমকে সালমান শাহর মৃত্যু আত্মহত্যা বলে রিপোর্ট দেওয়ায় অভিযুক্ত করা। দুই, এ কে আল মামুনের সরাসরি হস্তক্ষেপে নতুন তদন্তে হত্যা মামলা হিসেবে চার্জসিট দেওয়া। তিন, আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে জড়িয়ে তার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করা।

সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখাটিতে আরও বলা হয়, কথিত ওই সিনিয়র সাংবাদিকের দায়িত্ব ছিল এই চক্রের পক্ষে লেখা। চক্রটি তাদের পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়। মামলার তদন্ত এ কে আল মামুনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সিআইডিতে চলে যাওয়ায়। ওই সাংবাদিকও প্রথম ৪/৫ দিন চক্রের পক্ষে সাফাই লিখে পরে ভোল পাল্টান। নীলা চৌধুরী হয়ে পড়েন কোনঠাসা। পুলিশ কমিশনারকে জড়িয়ে তিনি আবার সংবাদ শিরোনাম হন। শিল্পপতি আজিজ মোহাম্মদ ভাই এবং ডিসি ডিবি ঘোষণা দেন, নীলা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করবেন। তাদের বক্তব্য, নীলা চৌধুরী সকল নাটের গুরু।

ঢালিউডকে ছায়া দেওয়া সালমানের অপমৃত্যু, ঘটনাপরম্পরাসালমান শাহ ও শাবনূর। ছবি: সংগৃহীত

বহু বছর পর সিআইডি থেকে সালমান শাহর অপমৃত্যুর মামলা যায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই)। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম ঢাকার সিএমএম আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৬০০ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

যা বলা হয়েছিল তদন্ত প্রতিবেদনে :

পাঁচ কারণে সালমান শাহ্ আত্মহত্যা করেছেন। এক, চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে তার অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা। দুই, স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ, তিন, বেশি আবেগপ্রবণ হওয়ার কারণে একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা, চার, মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা, যা জটিল সম্পর্কের বেড়াজাল তৈরি করে অভিমানে রূপ নেয় এবং পাঁচ, সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।

ঢালিউডকে ছায়া দেওয়া সালমানের অপমৃত্যু, ঘটনাপরম্পরাসালমান শাহর স্ত্রী সামিরা। ছবি: সংগৃহীত

 

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, যেভাবে মৃত্যু হলো সালমানের:

সালমান শাহর অপমৃত্যুর ঘটনাপ্রবাহ ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছিল পিবিআই। সেখানে দেখানো হয়: ডাবিং থিয়েটারে সালমান ও শাবনূরকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে রাগ করে বেরিয়ে যান স্ত্রী সামিরা। ঘটনার আগের রাত সাড়ে ১১টায় সালমানের মুঠোফোনে শাবনূরের কাছ থেকে ফোন আসে। এ সময় সালমান শাহ কথা বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকে যান। বাথরুমে গিয়ে সালমান শাহ চিৎকার করে বলছিলেন যে, তাকে যেন আর ফোন না করা হয়। এরপর রাত ১২টার দিকে তার মোবাইলে আবারও কল দেন শাবনূর। এ সময় সামিরা রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার উদ্দেশে নিচতলার লবিতে চলে যান। লবিতে সালমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবুল হোসেন খান বাসায় ফিরিয়ে আনার জন্য সামিরাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন।

সামিরা বাসায় ফিরে কান্নাকাটি করতে থাকেন। রাত আনুমানিক সোয়া ১২টার দিকে শাবনূরের মোবাইল থেকে আবারও কল আসে। শাবনূরের কল এসেছে দেখতে পেয়ে সালমান শাহ রাগে সিটিসেল মোবাইলটি মেঝেতে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলেন। এছাড়া শাবনূরের উপহার দেওয়া ফোনটিও ভেঙে ফেলেন। পরদিন সালমান শাহ বাসার কাজের সাহায্যকারী মনোয়ারা ভাঙা মোবাইলটি ময়লার ঝুড়িতে রেখে দেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সালমানের বাবা কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বাসায় আসেন। এ সময় সামিরা তার শ্বশুরকে চা-নাশতা দেন।

ঢালিউডকে ছায়া দেওয়া সালমানের অপমৃত্যু, ঘটনাপরম্পরাসালমান শাহ ইমন, মা নীলা চৌধুরী ও ছোট ভাই শাহরান চৌধুরী বিল্টু। ছবি: লেখকের নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকে

ঘটনার দিন সকালে সালমান শাহ ঘুম থেকে উঠে কিচেনে গিয়ে সাহায্যকারী মনোয়ারার কাছে পানি চান। মনোয়ারা এক মগ পানি দেন। সালমান শাহ পানি পান করে আরও এক মগ পানি চেয়ে নিয়ে তা পান করেন। পরে মালি জাকির কলিং বেল বাজায়। সালমান নিজেই দরজা খুলে দেন। এ সময় জাকির সালমান শাহর কাছে তিন মাসের বকেয়া বেতন চান। কিন্তু কোনো কথা না বলে ভেতরে চলে যান। পরে দারোয়ান দেলোয়ারকে ইন্টারকমে ফোন করে বলেন, তার বাসায় যেন কাউকে আসতে দেওয়া না হয়। এরপর বেডরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্ত্রী সামিরার দিকে একদৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে ছিলেন। সামিরা তখন বিছানায় শোয়া অবস্থান টিভি দেখছিলেন। সামিরা তখন সালমানকে জিজ্ঞাসা করে, কী দেখছো? সালমান শাহ কিছু না বলে বাথরুমে চলে যান। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি ড্রেসিং রুমে যান এবং ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। এ সময় আরেক সাহায্যকারী ডলি তার ছেলে ওমরকে বাথরুম থেকে গোসল করিয়ে বের হন। ওমরের কাপড়-চোপর ড্রেসিং রুমের ভেতরে থাকায় ওমর ও তার মা ডলি দরজা নক করেন। দরজা না খোলায় ওমর বাইরে থেকে বারবার ডাকতে থাকে। ওমর ও ডলি ডাকার পরও দরজা না খোলায় বিষয়টি সামিরাকে জানালে সামিরা ড্রেসিং রুমের চাবি এনে দরজা খোলে। তখন ওমর, ডলি, মনোয়ারা ও আবুল দরজার সামনে উপস্থিত ছিলেন।

ঢালিউডকে ছায়া দেওয়া সালমানের অপমৃত্যু, ঘটনাপরম্পরাসালমান শাহ। ছবি: সংগৃহীত

ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে সালমান শাহকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যায়। এ সময় সামিরা চিৎকার করে সালমান শাহকে নিচ থেকে উঁচু করে ধরেন। তাকে আবুল ও মনোয়ারা সহায়তা করেন। ডলি রান্নাঘর থেকে বটি এনে অ্যালুমিনিয়ামের মই বেয়ে ওপরে উঠে ফাঁসের রশি কেটে দেন। বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে সালমান শাহকে ধরাধরি করে পাশের বেডরুমে শোয়ানো হয়। সামিরা মাথায় পানি দেন, ডলি ও মনোয়ারা তেল গরম করে সালমানের বুকে, হাতে ও পায়ে মালিশ করতে থাকেন। খবর পেয়ে দারোয়ান দেলোয়ার সালমান শাহর ফ্ল্যাটে ছুটে আসেন। এরপর সালমানের বাবা, মা ও ভাইসহ অন্য স্বজনরাও আসতে থাকেন। তাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে সালমান শাহকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মৃত্যুর পরের ঘটনা পরম্পরা:

সালমান শাহকে খুন করা হয়নি, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। এ আত্মহত্যার পেছনে পাঁচটি কারণ ছিল।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা করেন তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী।

১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ প্রতিবেদনে সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়।

ঢালিউডকে ছায়া দেওয়া সালমানের অপমৃত্যু, ঘটনাপরম্পরাসালমান শাহ ও শাবনূর। ছবি: সংগৃহীত

আরও পড়ুন:

সিআইডির প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সালমান শাহর বাবা ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠানো হয়। এ আদেশের প্রায় ১২ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতেও সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।


২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবার রিভিশন আবেদন করেন নীলা চৌধুরী। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

আরএমডি/এমএমএফ/এমএস

আরও পড়ুন