বস্তিতে থেকে বিক্রি করতেন বই ও ফুল
একসময়ের সুপারহিট নায়িকা বনশ্রী যেভাবে নিঃস্ব হয়েছিলেন
চিত্রনায়িকা বনশ্রী
রুপালি জগতের হাতছানি, নায়িকা হিসেবে অভিনয়, তারকা খ্যাতি এবং সেই খ্যাতির স্বর্গ থেকে ভূমির ধূলায় লুটিয়ে পড়া, হারিয়ে যাওয়া এবং স্রেফ একজন মানুষ হিসেবে টিকে থাকার লড়াইয়ের এমন এক গল্প রেখে গেছেন নায়িকা বনশ্রী যা সিনেমাকেও হার মানায়। সিনেমা করতে এসে প্রথমটিতেই পেয়েছিলেন হিট নায়িকার তকমা। কি ছিল না তার তখন? নাম, অর্থ, মেধা, সৌন্দর্য; সব। কিন্তু সেই তিনি হারিয়ে গেলেন সময়ের স্রোতে। সিনেমার রঙিন জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে বস্তিতে থেকে বিক্রি করতেন বই ও ফুল। একসময়ের সুপারহিট নায়িকা বনশ্রী যেভাবে নিঃস্ব হয়েছিলেন, সেই গল্পটা জানতে চান যারা তাদের জন্য এই আয়োজন।
দীর্ঘদিন পর তার সন্ধান মিললো ফুল বিক্রেতা হিসেবে। প্রথম শুনে মনে হচ্ছিল বুঝি কোনো নাটক-সিনেমার চরিত্রে অভিনয় করছেন। কিন্তু সেটা ছিল বাস্তব। করুণ বাস্তব। পেটের দায়ে কিংবা জীবন চালিয়ে নেয়ার যুদ্ধে নায়িকা বনশ্রী টিকে ছিলেন ফুল বিক্রি করে। রুপালি পর্দার জৌলুসময় জীবনের আড়ালে হয়তো তিনি ভালোই ছিলেন নিজের মতো করে। তবে ২০১৯ সালে ফুল বিক্রেতা হিসেবে তাকে আবিষ্কার করার পর তার সরল সেই জীবনেও নেমে আসে খ্যাতির বিড়ম্বনার জটিলতা।
প্রচারের আলোয় চলে আসায় শান্তিতে ফুল বিক্রিও করতে পারেননি আর। প্রায় প্রতিদিনই নানা মিডিয়া হাজির হতো তার কাছে। ফুল বিক্রি রেখে সেইসব মিডিয়াতে বলতে হতো ভাগ্যের বিড়ম্বনার গল্প। বিরক্ত হয়ে একসময় আবার হারিয়ে যান বনশ্রী। সবার আড়ালে, নিভৃতচারীর জীবনে।
এক সাক্ষাৎকারে বনশ্রী বলে গেছেন তার সিনেমা জীবনের ছোট্ট গল্প। তার ভাষ্য, ‘প্রথম ছবি করেই আমি মানুষের চোখে পড়ে যাই। নামধাম হয়। ছবির নাম ‘সোহরাব রুস্তম’। ১৯৯৪ সালের পয়লা জুলাই মুক্তি পায় ছবিটি। পরিচালক ছিলেন মমতাজ আলী। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে এই ছবিতে ভালো কাজ করেছি। তাই হাতে আরো কাজ আসতে শুরু করে। ১৯৯৪ সালের ১৮ নভেম্বর আমার দ্বিতীয় ছবি মুক্তি পায়। নাম ‘মহা ভূমিকম্প’। পরিচালনা করেছেন সুভাষ ঘোষ। আমার সাথে নায়ক ছিলেন মান্না ভাই ও আমিন খান। ১৯৯৮ সালের ২৭ নভেম্বর ‘নেশা’ ছবিটি মুক্তি পায়। সাইদুর রহমান সাইদের পরিচালনায় অভিনয় করেছি আমি, রুবেল ভাই আর অঞ্জু ঘোষ। বুঝতেই পারছেন, তখন আমাকে মানুষ চিনতে শুরু করেছে।’

বনশ্রী ও সোহরাব রুস্তম সিনেমার পোস্টার
তার পরিবারিক নাম সাহিনা আকতার বনশ্রী। তিনি সুশ্রী ছিলেন কৈশোর থেকেই। কত ছেলে তার প্রেমে পড়েছেন হিসেব নেই। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন শ্যামল নামের একজন। ৯২ বা ৯৩ সালের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এক ছাত্র বনশ্রীদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। তার নাম ছিল শ্যামল কুমার কণ্ঠ। তিনি বনশ্রীকে ভালোবাসতেন। রোজ লিখতেন চিঠি। বনশ্রীর পাত্তা না পেয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছিলেন। পরে সব জেনে শ্যামলের মা বনশ্রীর বাড়িতে গিয়ে তার বাবার হাতে ছেলেকে তুলে দেন ‘ছেলের মৃত্যুর চেয়ে মুসলমান ছেলে অনেক ভালো’ এই দাবি করে। সেদিনই শ্যামলের সঙ্গে বনশ্রীর বিয়ে হয়ে গেল। শ্যামল কুমার কণ্ঠ ধর্ম ও নাম বদলে হয়ে গেলেন মাসুদ চৌধুরী। এত রোমান্টিক গল্পটাও এক সময় বিষাদের হয়ে গেল। যে মানুষ বনশ্রীকে পাওয়ার জন্য গায়ে আগুন দিয়ে মরতে চেয়েছিলেন সেই মাসুদ একদিন বনশ্রীকে ফেলে চলে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন একমাত্র কন্যা শ্রাবন্তীকেও। কিন্তু কেন?
সেই গল্প জানতে গেলে জানতে হবে বনশ্রীর সিনেমায় আসা ও হারিয়ে যাওয়ার গল্পে। মাদারীপুরের শিবচরে জন্ম সাহিনা আকতারের। খুব ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসেন। মোহম্মদপুরেই বড় হয়েছেন তিনি। বেগম নূরজাহান বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তেন। ছোটবেলা থেকে গান করতেন। প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল নায়িকা হবেন। কেউ তাকে দেখলেই বলত সুচরিতার মতো দেখতে, কেউ বলত এ তো দেখি নায়িকা নতুনের মতো, আবার কেউ বলত দিতির মতো, শাবানার মতো। এসব শুনে শুনে মাথায় ঢুকে যায় নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সেই তার বিয়ে হয়ে যায় ওই প্রেমিক শ্যামলের পাগলামিতে।
বিয়ের পর আবার নায়িকা হওয়ার বাসনা জেগে ওঠে। স্বামীর অনুমতি নিয়ে এফডিসিতে যোগাযোগ করেন। পরিচয় হয় এফটি প্রোডাকশনের মালিক মোহাম্মদ ফারুক ঠাকুরের সঙ্গে। সেই পরিচয়ই সাহিনা আকতারকে নায়িকা বনশ্রী করে তুলেছিল। আবার সেই পরিচয়ের কারণেই করুণ এক জীবন কাটিয়ে গেলেন বনশ্রী। প্রযোজক মোহাম্মদ ফারুক ঠাকুর খুবই পছন্দ করেন বনশ্রীকে। তার প্রযোজনারই সিনেমা ছিল ‘সোহরাব রুস্তম’। সেই ছবি হিট হতেই প্রচুর অফার আসে বনশ্রীর কাছে। মোহাম্মদ ফারুক ঠাকুর তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও সিনেমা করা যাবে না। বনশ্রী অভিমান করলেন। মোহাম্মদ ফারুক ঠাকুর তার মান ভাঙাতে ঘোষণা দিলেন, বনশ্রী যেসব ছবি করবেন এফটি প্রোডাকশন থেকে সেসব ছবির মুনাফাও পাবেন তিনি। আর এভাবেই বনশ্রী হয়ে গেলেন প্রযোজকও। সব ঠিকঠাক চলছিল। নায়ক মান্না, রুবেলদের সঙ্গে জুটি বাঁধেন বনশ্রী। হঠাৎ একটি ঘটনা সব বদলে দেয়।

বনশ্রী
ফিট থাকার জন্য গুলশানের যে বাড়িতে সুইমিং করতে যেতেন বনশ্রী সেই বাড়িতে একটি খুনের দায়ে গ্রেফতার হন মোহাম্মদ ফারুক ঠাকুর। আর তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে বনশ্রীর নামও চলে আসে খবরের পাতায়। কেউ তাকে মোহাম্মদ ফারুক ঠাকুরের রক্ষিতা হিসেবে পরিচয় করালেন, কেউ বানালেন প্রেমিকা-স্ত্রী। এতে করে সকল পরিচালক, প্রযোজক বনশ্রীকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে।
এ সময়ই তাকে ত্যাগ করেন শ্যামল থেকে ধর্ম বদলে মাসুদ হওয়া স্বামীও। তিনি যাবার বেলায় সঙ্গে করে নিয়ে যান একমাত্র কন্যা শ্রাবন্তী শ্যামল বৃষ্টিকে। একা হয়ে দিন কাটে বনশ্রীর। এক সময় দেখা দেয় আর্থিক সংকট। শিল্পী সমিতিতে কয়েক দফা সাহায্য চেয়েছেন। লাভ হয়নি। শিল্পীদের সভাপতি শাকিব খান ও সেক্রেটারি মিশা সওদাগর সুনজর দেননি তাদের সহশিল্পী বনশ্রীর দিকে।
বাধ্য হয়ে নেমে তিনি পথে নামেন। ফুটপাতে বই বিক্রি করেছেন অনেকদিন। একটা বিয়েও করেন নিরাপত্তার জন্য। সেই সংসারে জন্মায় ছেলে মেহেদি হাসান। কিছুদিন পর স্বামী লাপাত্তা। এবার দুটি পেটের খাবারের যোগান দিতে রাস্তায় নেমে যান বনশ্রী। কখনো বই বিক্রি করেছেন, কখনো ফুল। ঝলমলে দুনিয়ায় অপার সম্ভাবনা জাগানো এক নায়িকা বেঁচে থাকার জন্য চরম সংগ্রাম করে চলেন অবিরাম।
ফুল বিক্রি করতে গিয়ে তিনি প্রচারে আসেন। এরপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রাণ তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য দেন তাকে। ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়ী তহবলি পাওয়ার পর মাসে ২১ হাজার টাকা করে তুলতে পারতেন বনশ্রী। ছেলেকে নিয়ে থাকতেন তখন মোহম্মদপুরের শেখেরটেকের বস্তিতে।
একসময় সেখান থেকে চলে যান বাপের ভিটা মাদারিপুরে। ছেলেকে নিয়ে সেখানেই শেষ জীবনটা কাটিয়ে গেছেন বনশ্রী। রোগে-অভাবে ভুগে আমৃত্যু লড়াই করেছেন নিষ্ঠুর এক নিয়তির সঙ্গে। আপাতত সব যুদ্ধের অবসান হয়েছে। বনশ্রীকে আর তার ভাগ্য নিয়ে মন খারাপ করতে হবে না। ভাবতে হবে না অভাব নিয়েও। বনশ্রী চলে গেছেন পৃথিবীর সব খেলা থামিয়ে। তিনি বেঁচে থাকবেন ঢাকাই সিনেমার এক হতভাগী নায়িকার গল্পে, সিনেম্যাটিক এক জীবনেরও নায়িকা হিসেবে।
এলআইএ/এমএস