সিলেটের মণিপুরী শাড়ি বাংলার নতুন সাংস্কৃতিক পরিচয়

রফিকুল ইসলাম জসিম
মণিপুরী শাড়ি, বাঙালি নারীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তবে এখন এটি শুধু ১২ হাতের একটি শাড়ি নয়, মণিপুরী শাড়ি এখন এক সাংস্কৃতিক পরিচয়, গৌরবের প্রতীক। সম্প্রতি এই ঐতিহ্যবাহী শাড়ি পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি। আর এ খবরে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার মণিপুরী জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে মণিপুরী পল্লীগুলোতে বইছে উৎসবের হাওয়া। তাঁতের ঘরে ঘরে চলছে আনন্দ, গর্ব আর ভবিষ্যতের নতুন স্বপ্ন বোনার আয়োজন।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
ঐতিহ্যের শিকড়ে গর্ব: বহু শতাব্দীর ইতিহাস বয়ে আনা মণিপুরী তাঁতশিল্প কেবল বয়নশিল্প নয়, এটি একটি জীবন্ত সংস্কৃতি। হাতে বোনা, বর্ণিল রঙে নকশা করা এই শাড়িগুলো শুধু পোশাক নয়-একটি গল্প, একটি ইতিহাস। মণিপুরী সমাজের নারীরা ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে শেখেন তাঁতের কৌশল। ঘরে বসেই চলে শাড়ি বোনা।
কমলগঞ্জের আদমপুরের ঘোরামারা গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী সালেহা বেগম বলেন, ‘আমার মা যেমন শিখিয়েছিলেন, তেমনি আমি শিখিয়েছি আমার মেয়েকে। আজ আমাদের এই শাড়ি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেল এই আনন্দ ভাষায় বোঝানো যায় না।’
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
তাঁতির ঘরে আজ উৎসব জিআই স্বীকৃতির খবরে তাঁতিরা যেমন খুশি, তেমনি আশাবাদীও। কারণ এই স্বীকৃতি বাজার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশিয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে মণিপুরী শাড়ির পরিচিতি যেমন বাড়বে, তেমনি তাঁতিদের আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হবে। মাধবপুরের তাঁতি মমতা সিনহা বলেন, ‘এই স্বীকৃতি আমাদের পরিশ্রমের স্বীকৃতি। এখন আমরা আরও ভালো মানের কাজ করতে উৎসাহী হচ্ছি। বিদেশেও এখন আমাদের শাড়ি যাবে।’
উৎপাদকদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার
জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর মণিপুরী নারীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই বলছেন, এখন তাঁতশিল্প শুধুই জীবিকার উৎস নয়, এটি গর্বের অংশ।
বিজ্ঞাপন
ইসলামপুরের এক নারী তাঁতি সালমা বলছিলেন, ‘আগে বলতাম তাঁত বুনি। এখন বলতে পারি, এই পণ্যের কারিগর আমি!’ অনেকেই এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের তৈরি শাড়ি বিক্রি করছেন। তাদের বিশ্বাস, এই স্বীকৃতি আগামী প্রজন্মকে এই পেশায় উৎসাহিত করবে।
জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এক নারী তাঁতি বলেন, ‘আমরা তো ঘরে বসে শাড়ি বুনি, এখন মনে হচ্ছে আমাদের কাজও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল। এখন সরকার যদি সহায়তা করে, তাহলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারব।’
এক নারী উদ্যোক্তা প্রীতি দেবী জানান, ‘জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমরা এখন একটি অনলাইন স্টোর চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। যাতে দেশ-বিদেশের মানুষ সহজে মণিপুরী শাড়ি কিনতে পারে।’
বিজ্ঞাপন
একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশা মণিপুরী শাড়ির জিআই স্বীকৃতি শুধু একটি বস্ত্রশিল্পের জয় নয়, এটি এক প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের জয়, তাদের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান। এটি নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে নিজ শিকড়কে ভালোবাসতে, ধরে রাখতে। আর তাই সিলেটের মণিপুরী পল্লীগুলো আজ শুধু শাড়ি বুনছে না-তারা বুনছে এক নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন।
সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সেতুবন্ধন মণিপুরী শাড়ি এখন শুধু ঐতিহ্য নয়, সম্ভাবনাও। পর্যটন ও হস্তশিল্প নির্ভর একটি নতুন অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে এই জিআই ট্যাগকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় প্রশাসন ও এনজিওগুলোও এই শিল্পকে টেকসই করার জন্য প্রশিক্ষণ ও মার্কেটিং সাপোর্টের উদ্যোগ নিচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
মণিপুরী শাড়ির ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে এটি পেয়েছে জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) ট্যাগ। এই অর্জনকে তাঁতশিল্পের জন্য এক যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে দেখছেন দেশের বিভিন্ন গবেষক ও ফ্যাশন ইতিহাসবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও কারুকলা অনুষদের একজন গবেষক বলেন, ‘মণিপুরী শাড়ি কেবল পোশাক নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক নিদর্শন। এর বুননশৈলী, রঙের মেলবন্ধন, এবং প্রতিটি নকশায় রয়েছে একটি জাতির ইতিহাস ও জীবনচেতনার প্রতিফলন।জিআই স্বীকৃতি ঐতিহ্যকে সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে একইসঙ্গে দরকার মাঠপর্যায়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ।’
মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা প্রবাস কুমার সিনহা জানান, ‘অনেকেই মণিপুরী শাড়িকে সাধারণ তাঁতশাড়ির মতো বিবেচনা করেন। অথচ এর পেছনে রয়েছে মেইতেই,পাঙাল ও বিষ্ণুপ্রিয়া সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। এই জিআই স্বীকৃতি সেই ভুল ধারণা ভাঙতে সহায়ক হবে।’
গবেষকদের মতে, এখন জরুরি হলো শাড়ির নকশা, উপকরণ ও বুননপ্রক্রিয়া নিয়ে আরও প্রামাণ্য গবেষণা চালানো, তাঁতশিল্পীদের মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, এবং জিআই ট্যাগ সংরক্ষণের জন্য সরকার ও স্থানীয় সংগঠনের যৌথভাবে মাননিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলা। তাদের মতে, জিআই স্বীকৃতি যতটা গুর“ত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার। না হলে এটিও কেবল একটি সনদ হয়েই থাকবে।
বিজ্ঞাপন
অনেক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক গবেষক মনে করেন, জিআই ট্যাগ সিলেটের মনিপুরীদের বস্ত্র, খাদ্য ও হস্তশিল্পের গৌরবময় ইতিহাসকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরবে। এটি স্থানীয় শিল্পীদের আত্মপরিচয় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। মণিপুরী সাহিত্যিক এ.কে শেরাম মনে করেন, জিআই ট্যাগ কেবল অর্থনীতিক নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষা, আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের হাতিয়ার।
মণিপুরী শাড়ির জিআই স্বীকৃতি এই স্বীকৃতি পেয়ে উচ্ছ্বসিত মণিপুরী তাঁত বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট তাঁতশিল্পীরা। তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান জনাব আবু আহমদ ছিদ্দীকী জানান, ‘এটি শুধু আমাদের ঐতিহ্যের স্বীকৃতি নয়, বরং মণিপুরী তাঁতশিল্পের আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও বাজার সম্প্রসারণে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
তাঁত বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জিআই ট্যাগের ফলে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, নকল প্রতিরোধ এবং প্রামাণিক উৎপাদন নিশ্চিত করা সহজ হবে। একই সঙ্গে তাঁতশিল্পীদের প্রশিক্ষণ, ডিজাইন উদ্ভাবন এবং রপ্তানিমুখী উৎপাদনে নতুন প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
তাঁত বোর্ড আশা করছে, এই স্বীকৃতির ফলে তরুণ প্রজন্ম এই শিল্পে আগ্রহী হবে এবং নারীকেন্দ্রিক এই শিল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাঁত বোর্ড এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরু করেছে, যাতে জিআই ট্যাগের ব্যবহার ও তার গুরুত্ব তাঁতশিল্পীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
গত ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধায় আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে সিলেটের মণিপুরী শাড়িকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের হাত থেকে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের সদস্য (যুগ্মসচিব) দেবাশীষ নাগ জিআই সনদের প্রতীকী দলিল গ্রহণ করেন।
সিলেটের মণিপুরী শাড়ি এখন আর কেবল একটি পোশাক নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক ধরনের নীরব সংস্কৃতি, যা বহন করে ইতিহাস, বিশ্বাস, নারীশ্রম এবং প্রজন্মের স্মৃতি। জিআই স্বীকৃতি সেই গল্পকে কেবল সংরক্ষণই করছে না, তাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরছে, বিশ্বকে জানাচ্ছে ‘সিলেটের মণিপুরি শাড়ি’ শুধুই শাড়ি নয়, এটি বাংলাদেশের এক গর্বিত সাংস্কৃতিক পরিচয়।
- আরও পড়ুন
অদম্য দুই উদ্যোক্তা ফাতেমা-ইয়াসমিন নারীদের অনুপ্রেরণার নাম
সেদিন শরণার্থী শিবিরে আলোর দূত হয়ে আসেন ধাত্রী শাকিলা
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।
কেএসকে/জেআইএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন