ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

ধামরাইয়ের রথযাত্রা: ইতিহাস-ঐতিহ্যের মহোৎসব

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৫:৩৫ পিএম, ২৭ জুন ২০২৫

সানজিদা জান্নাত পিংকি

যখন বর্ষার প্রথম মেঘ জমে আকাশে, মাঠের প্রান্তর ভিজে ওঠে কাদায় আর কাক ডাকে সন্ধ্যাবেলায় ধূসর আলোয়—ঠিক তখনই ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ের বুকজুড়ে শোনা যায় এক অন্তর্গত ব্যস্ততার সুর। রং, কাঠ, কাপড়, করাত আর কল্পনার সংমিশ্রণে তৈরি হতে থাকে ঐতিহাসিক কাঠামো—রথ। প্রায় চার শতাব্দী ধরে টিকে থাকা এ রথযাত্রা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব নয়; হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক লোকজ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিল্প আর মানবিক সহাবস্থানের মহোৎসব।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এ আঞ্চলিক রথযাত্রার পেছনে লুকিয়ে আছে এক ইতিহাস। ধামরাইয়ের জমিদার শ্রী যশোপাল একদিন নিজের সৈন্যসৈকত নিয়ে যাত্রা করছিলেন। বনভূমির একটি ঢিবির কাছে তাঁর হাতি হঠাৎ থেমে যায়। বাধ্য হয়ে ঢিবিটি খননের নির্দেশ দিলে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ও কিছু মূর্তি পাওয়া যায়। শ্রী যশোপাল ভক্তি দিয়ে সেসব বাড়িতে নিয়ে আসেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে মাধব দেবতার দর্শন পান। যিনি তাঁকে নির্দেশ দেন পূজার আয়োজন করার এবং নিজেকে ‘যশোমাধব’ নামে পরিচয় দেওয়ার। এভাবেই ধামরাইয়ের রথযাত্রার সূচনা। যা প্রতি বছর আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে আয়োজন হয় এবং আজও ভক্তদের হৃদয়ে জ্বলজ্বলে আলো হয়ে টিকে আছে।

জানা যায়, বাংলা ১২০৪ থেকে ১৩৪৪ সালের মধ্যে ঢাকা জেলার সাটুরিয়া থানার বালিয়াটির জমিদাররা ধারাবাহিকভাবে চারটি রথ নির্মাণ করেন। ১৩৪৪ সালে নারায়ণগঞ্জের সূর্যনারায়ণ সাহা ছিলেন রথ নির্মাণের ঠিকাদার। প্রায় এক বছর সময় নিয়ে ধামরাই, কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া ও সিঙ্গাইর এলাকার দক্ষ কাঠশিল্পীরা একযোগে ৬০ ফুট উচ্চতার ত্রিতলবিশিষ্ট রথটি নির্মাণ করেন। এতে প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় চারটি করে প্রকোষ্ঠ এবং তৃতীয় তলায় একটি বৃহৎ প্রকোষ্ঠ ছিল। বালিয়াটির জমিদাররা চলে যাওয়ার পর রথের দায়িত্ব পালন করেন টাঙ্গাইলের রণদাপ্রসাদ সাহার পরিবার। যুগের পর যুগ ধরে এ ঐতিহ্য সংরক্ষিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহ্যের পুনর্গঠন হয় ২০১০ সালে। ভারতীয় কারিগর ও স্থানীয় ভক্তদের প্রচেষ্টায় নির্মিত হয় ৩৭ ফুট উচ্চতা ও ২০ ফুট প্রস্থের বিশালাকার রথটি। লোহার খাঁচার ওপর সেগুন ও চাম্বল কাঠ বসিয়ে খোদাই করা হয়েছে মনোমুগ্ধকর নকশা। পাশে রয়েছে কাঠের তৈরি দুটি ঘোড়া ও সারথির মূর্তি আর রথে লোহার ১৫টি চাকাও রয়েছে, যা এটিকে অদম্য শক্তি ও স্থায়িত্ব দেয়।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

রথের বিভিন্ন ধাপে কাঠের দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়, যা ভক্তদের আধ্যাত্মিক অনুভূতিকে আরও জোরালো করে। প্রতি বছর রথযাত্রার আগে রংচরানো ও সাজসজ্জার মাধ্যমে এটি উৎসবের মর্যাদায় সজ্জিত হয়। রথযাত্রার মূল আকর্ষণ ‘মাধব মন্দির’ থেকে জগন্নাথ দেব, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি নিয়ে রথ টানা যাত্রা গোপীনগরের ‘গুন্ডিচা মন্দির’ প্রতিরূপ মঞ্চ পর্যন্ত। বিশাল রশিতে টান দিয়ে হাজারো ভক্ত ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি আর সিঁদুরের লালিমায় মেতে ওঠেন।

রথের পেছনে ছুটে আসে সব বয়সের মানুষ; শিশুরা হর্ন বাজায়, তরুণীরা কেনে কাঁচের চুড়ি, প্রবীণরা নস্টালজিক কথায় মেতে ওঠে। মেলায় রয়েছে পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস এবং গ্রামীণ খাবারের পসরা। এটি শুধুই উৎসব নয়, অনেকের জন্য মৌসুমি জীবিকা। সপ্তাহখানেক পর অনুষ্ঠিত হয় ‘উল্টো রথ’—যেখানে দেবতাদের মাধব মন্দিরে ফেরানো হয়। এদিন মেলার ভিড় সর্বোচ্চ হয় এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কেউ বলেন, ‘উল্টো রথ না এলে রথযাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।’

তবে এ আনন্দের মাঝে রয়েছে বাস্তব চ্যালেঞ্জ। ভিড় নিয়ন্ত্রণ, যানজট, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ময়লা-আবর্জনা ও পরিবেশ দূষণ—এসব সমস্যা রথযাত্রার পথে বাধা। বিশেষ করে বর্ষাকালে ভারী বর্ষণ ও কাদা জমাট হওয়ায় যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা মাথায় রেখে আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

ধামরাইয়ের রথ শুধু কাঠ ও রশির সমাহার নয়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের উৎসব। যেখানে ইতিহাস, শিল্প, আস্থা ও সংস্কৃতি মিলেমিশে এক হয়ে ওঠে। যশোমাধবের পূজা ও রথ টানার আধ্যাত্মিকতা থেকে মেলার কোলাহল—সব মিলিয়ে এটি এক অনন্য সাংস্কৃতিক মহোৎসব। এ উৎসবে বেজে ওঠে সমাজের সহনশীলতা, ঐক্যবদ্ধতা ও মানবতার গান। বাংলাদেশে এ উৎসব টিকে আছে মানুষের সংহতির উৎস হিসেবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন