বিশ্ব চকলেট দিবস
ইউরোপে চকলেট আসে ওষুধ হয়ে

চকলেট ছেলে-বুড়ো সবারই পছন্দের খাবার। প্রেমিকার মন ভালো করতে কিংবা সন্তানের কান্না ভোলাতে চকলেট সবচেয়ে ভালো অস্ত্র বলা যায়। চকলেট যে শুধু অভিমান ভাঙায় তা নয়, এটি স্বাস্থ্যের জন্যও খুবই উপকারী। আচ্ছা আজ স্বাস্থ্য উপকারিতার দিকে যাচ্ছি না, বলব চকলেটের এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস।
চকলেট আজকের দিনে প্রেমের প্রতীক, আনন্দের উৎস, শিশুদের প্রিয় মিষ্টি। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় ফিরে গেলে দেখা যাবে এই মিষ্টির যাত্রা মোটেই এত সহজ ছিল না। আজ যে চকলেট আমরা খাই ডেজার্ট হিসেবে, এই চকলেট একসময় খাওয়া হতো ওষুধ হিসেবে। মরিচের গুঁড়ার সঙ্গে মিশিয়ে এক ধরনের পানীয় তৈরি করে খাওয়া হত। তবে এই পানীয় আগে উৎসর্গ করা হতো দেবতাদের।
চকলেট প্রথম যখন ইউরোপে আসে, তখন এটি ছিল না কোনো মিষ্টান্ন, বরং ধরা হতো একধরনের ওষুধ ও শক্তিবর্ধক টনিক হিসেবে। ১৫০০ সালের গোড়ার দিকে স্প্যানিশ কনকুইস্তাদর হার্নান কোর্তেস মধ্য আমেরিকার অ্যাজটেক সাম্রাজ্য জয় করেন। সেখানে তিনি এক রহস্যময় পানীয়ের সঙ্গে পরিচিত হন ‘এক্সোকোলাট’, যার অর্থ ‘তিতা পানীয়’। এটি ছিল কোকো বিন দিয়ে তৈরি একধরনের গাঢ়, মসলা দেওয়া গরম পানীয়, যা অ্যাজটেকদের কাছে ছিল পবিত্র এবং শক্তিদায়ক।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
কোর্তেস এই কোকো বিন ও তার প্রক্রিয়াটি ইউরোপে নিয়ে আসেন। তবে ইউরোপিয়ানদের কাছে এই তিতা, মসলাযুক্ত পানীয় প্রথমে ছিল অদ্ভুত ও অপ্রীতিকর। তাই তারা এতে চিনি, দুধ, মধু, দারুচিনি ইত্যাদি মেশাতে শুরু করল আর তখনই বদলে যেতে লাগল চকলেটের চেহারা ও উদ্দেশ্য।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
তবে অ্যাজটেক সংস্কৃতিতে কোকো বিনস সোনার চেয়ে মূল্যবান বলে মনে করা হত। অ্যাজটেক চকলেট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি উচ্চ-শ্রেণির মানুষের ব্যবহারের জিনিস ছিল। যদিও নিম্নবিত্তরা মাঝে মধ্যে বিবাহ বা অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোতে এটি উপভোগ করত। অ্যাজটেক শাসক দ্বিতীয় মন্টেজুমা ছিলেন কোকোর অনেক বড় ভক্ত। এটি ছিল তার কাছে অনেকটা মাদকের মতোই। তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি এবং একটি অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসেবে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে চকলেট পান করতেন। এমনকি তিনি কোকো বিনস তার সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষণও করে রাখতেন।
অন্যদিকে মায়ানরা তাদের নিজেদের সংস্কৃতিতে কোকো চকলেট হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। মায়ানরা কোকো বিনস শুধু খাবার হিসেবেই ব্যবহার করতো না, তারা এটিকে রীতিমতো শ্রদ্ধা করতো। মায়ানদের লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপনে এবং গুরুত্বপূর্ণ লেনদেন চূড়ান্ত করতে চকলেটকে পানীয় হিসেবে ব্যবহার করতো।
বিজ্ঞাপন
মায়ান সংস্কৃতিতে চকোলেটের এরকম গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, এটি শুধু মাত্র ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত ছিল না। প্রায় সব ধরনের মানুষের জন্য এটি সহজলভ্য ছিল। মায়ানদের অনেক পরিবারে প্রতিটি খাবারের সঙ্গে চকলেটের ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। মায়ানদের ব্যবহৃত চকলেট অনেক ঘন এবং সাদা হতো। এটি তারা মরিচ, মধু বা পানির সঙ্গে মিলিয়ে তারা এটাকে পানীয় হিসেবে ব্যবহার করতো।
১৬শ ও ১৭শ শতকে ইউরোপের ধনীরা চকলেটকে শুধু পান করার জন্য ব্যবহার করত না, এটি ব্যবহৃত হতো নানা শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায়। হজম শক্তি বাড়ানো, মেজাজ উন্নত করা, ঠান্ডা-জ্বরের প্রতিকার, যৌনক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। বিশেষ করে ইতালিয়ান চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টরা চকলেটের গুণাবলি নিয়ে নানা গবেষণা করতে থাকেন। সেসময় কিছু চিকিৎসা বইয়ে লেখা থাকত: চকলেট ওয়ার্মস দ্য স্টোমাক, স্ট্রেন্থস দ্য হার্ট অ্যান্ড ক্লিনস দ্য লিভার।
বিজ্ঞাপন
চকলেট ছিল এতটাই দামি যে এটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। ইংল্যান্ডের রানি অ্যান অব অস্ট্রিয়া, ফ্রান্সের রাজা লুই ১৪, এমন অনেক রাজপরিবারে চকলেট ছিল প্রতিদিনের রিচুয়ালের অংশ। ফ্রান্সের রাজদরবারে তো বলা হতো: অ্যা কাপ অব চকলেট অজ মর্নিং কিপস ফ্যাটিগুই অ্যান্ড স্যাডনেজ অ্যাওয়ে।
১৮শ শতকের শেষ দিকে ইউরোপের কিছু দেশে চকলেট পাওয়া যেত ঔষধের দোকানে। এটি ছিল টনিকের মতো, মাঝে মাঝে মিশ্রণ থাকত কফি, আফিম বা হেলথ টনিকের সঙ্গে। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে অনেক ডাক্তার এটিকে উদ্দীপক এলিক্সির হিসেবে প্রেস্ক্রাইব করতেন।
বিজ্ঞাপন
১৮৪৭ সালে ব্রিটেনের জে.এস ফ্রাই অ্যান্ড সনস প্রথম চকলেট বার তৈরি করে। তার আগে পর্যন্ত চকলেট ছিল মূলত পানীয় বা ওষুধ। এরপর সুইস কোম্পানি নেসলে ও ড্যানিয়েল পিটার দুধ চকলেটের ধারণা বাজারে আনে। সেই থেকে চকলেট ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক আনন্দদায়ক মিষ্টিতে, আর হারিয়ে যেতে থাকে তার ‘ওষুধ’ পরিচয়।
আজ চকলেট ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর উপহারের প্রতীক। কিন্তু তার ইতিহাসে মিশে আছে রাজনীতি, ধর্ম, স্বাস্থ্যচিকিৎসা, এমনকি দাসপ্রথা। সেই পুরনো দিনগুলো মনে করিয়ে দেয় এই ছোট্ট মিষ্টি বারটি কেবল মুখের স্বাদই বাড়ায় না, বহন করে এক গহীন ইতিহাসের ছোঁয়া।
সূত্র: চকলেট মাংগো, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন অব হেলথ
কেএসকে/এএসএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন