গ্রামীণ নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি ও অধিকার সময়ের দাবি
গ্রামীণ নারীদের অবদান
ভোরের সূর্য ফোটার আগেই যে নারী উঠোন ঝাড়ে, গরুকে খাওয়ায়, চুলায় ভাত চাপায়-সেই নারীর মাঝেই লুকিয়ে আছে এই দেশের গ্রামীণ জীবনের প্রাণ। দিনের শুরুতেই যখন গ্রামের সব কাজ শুরু হয়, তখন তার নিঃস্বার্থ পরিশ্রমে বাড়িজুড়ে যেন জীবনসঞ্চার হয়ে ওঠে। তবে সেই নারীকে কেবল ‘গৃহিণী’ নামেই পরিচয় দেওয়া হয়। অথচ তারাও ঘরের কাজের পাশাপাশি পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাদেরই জন্য অনেক পরিবার সংকটকাল পার করতে পেরেছে, তাদের জন্যই গ্রামের ছোট ছোট উদ্যোগ ও ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠেছে। তবে তাদের কাজকে শুধু দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয় সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি আজ অনেকখানি নারীর কাঁধে দাঁড়িয়ে। তারা শুধু ঘর সংসারের দায়িত্ব পালন করেন না, বরং দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে এক অমূল্য অবদান রাখেন। ধান মাড়াইয়ের কাজ থেকে শুরু করে কৃষির বিভিন্ন কাজ, হাঁস-মুরগি পালন, বাড়ির আঙিনায় শাকসবজি চাষ, কাপড় সেলাই, নকশি কাঁথা তৈরিসহ-সব ক্ষেত্রেই নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ে। শুধু তাই নয়, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবেও তারা পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছেন।
মাইক্রো ক্রেডিটের হাত ধরে অনেক নারী ছোট ছোট স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। কেউ পিঠা বানিয়ে, কেউ মাটির কাজ করে, আবার কেউ তাঁতের বস্ত্র তৈরি করে নিজের মতো করে সংসার চালান। এই উদ্যোগগুলো শুধু পরিবারের আয় বাড়ায় না, বরং সমাজে আত্মনির্ভরতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
শুধু তাই নয় আরও এক ধরনের অবদান রয়েছে, যা প্রায় সময় সমাজের চোখে অদৃশ্য থেকে থাকে-যা সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা যেন নিয়মিত স্কুলে যায়, তাদের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি হয়, সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধেই।

এছাড়া তারা সচেতন করেন পরিবারকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে, পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করতে, যাতে রোগব্যাধি থেকে পরিবার সুরক্ষিত থাকে। পরিবেশের যত্ন নেওয়া, যেমন গাছ লাগানো, পানি সংরক্ষণ, এসব বিষয়েও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাই বলা যায়, গ্রামীণ নারীরা শুধু পরিবারেরই নয়, পুরো সমাজের পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি।
তবে নারীদের অবিস্মরণীয় অবদানের মাঝেও সমাজের বাস্তব চিত্র অনেক ভিন্ন এবং দুঃখজনক। তাদের শ্রমের মূল্যায়ন আজও অনেক সময় হয় না সঠিকভাবে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক হিসেবে। তাদের কঠোর পরিশ্রমকে আমরা অনেক সময় ‘দায়িত্ব’ হিসেবেই দেখেছি, ‘কর্ম’ বা যোগ্য অর্জন হিসেবে নয়। ঘর-বাইরের অসংখ্য কাজ করার সত্ত্বেও, পরিবার কিংবা সমাজের অনেক জায়গায় নারীর কাজকে স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন দেওয়া হয় না। তাদের পরিশ্রমের ফলাফল ও সফলতা যেন দেখা হয় স্বাভাবিক। কখনো প্রশংসার যোগ্য মনে হয় না।
বিশেষ করে বর্তমান ডিজিটাল যুগে, যেখানে প্রযুক্তি প্রতিদিন মানুষের জীবনকে সহজ করে তুলছে, সেখানে গ্রামীণ নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার থাকা জরুরি। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তারা সহজেই আর্থিক লেনদেন করতে পারবেন, অনলাইন বাজারের মাধ্যমে নিজস্ব পণ্য বিক্রি করে আয় বৃদ্ধি করতে পারবেন, আর কৃষি সম্পর্কিত তথ্যগুলো জানতে পারলে উৎপাদন ও ফলন বাড়াতে সক্ষম হবেন। এতে তারাই হয়ে উঠতে পারেন ভবিষ্যতের ডিজিটাল উদ্যোক্তা। এতে পরিবার ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে।
রাষ্ট্র ও সমাজ দু’য়েরই দায়িত্ব নারীর অধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া। প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সামাজিক স্বীকৃতি-এসব বাস্তবায়ন করলে গ্রামীণ নারীরা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। ঋণ সহায়তার ব্যবস্থা থাকলে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উদ্যোক্তা হিসেবে তারা সফল হতে পারবে। এতে অন্য নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করার সুযোগ পাবে। তবে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাও অপরিহার্য, যেখানে নারী নির্ভয়ে কাজ করতে পারবে, তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা পাবে।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শুধু উন্নয়নের পরিসংখ্যান নয়, পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান। তাদের কাজের সহায়তায় পুরুষ সদস্যদের এগিয়ে আসতে হবে। এতে নিজেকে এগিয়ে নিতে নারীরা আরও সাহস পাবে।
গ্রামীণ নারীরা কেবল সমাজের পেছনের গল্প নন, তারা সামনের কাহিনির নায়িকা। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয় এটি ন্যায্যতার দাবি, এটি মানবতার দাবি। যেদিন প্রতিটি নারী নিজের শ্রম, জ্ঞান ও মর্যাদার মূল্য পাবেন, সেদিনই সত্যিকারের উন্নত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। যেখানে উন্নয়নের মানচিত্রে প্রতিটি নারী থাকবে আলোকিত হয়ে।
আরও পড়ুন
ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ যেখানে, নাক হারাতে বসেছিলেন রুহি চেনেট
আজকের কন্যাশিশু ভবিষ্যতের নোবেল বিজয়ী
কেএসকে/এএসএম