সময়ের পরিবর্তনে অবসর কাটানোর ধরন
ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এখন অবসর কাটে
সময় বদলাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে মানুষের বিনোদনের ধরনও। একসময় বিকেলের নির্জনতায় হাতে বই নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা ছিল অবসর কাটানোর সবচেয়ে শান্ত ও প্রিয় উপায়। মোটা উপন্যাসের পৃষ্ঠা উল্টানোর শব্দ, কিংবা কবিতার ভেতর হারিয়ে যাওয়াই ছিল আমাদের নিঃশব্দ আনন্দের নাম। কিন্তু এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে মোবাইল স্ক্রিন, শর্ট ভিডিও আর অন্তহীন রিলসের দুনিয়া। কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য আর অ্যালগরিদম করা উত্তেজনায় তরুণদের মন ডুবে আছে নতুন এক বাস্তবতায়।
প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তনকে তরুণ প্রজন্ম কীভাবে দেখছে? নিজেদের অবসর যাপন, একাকিত্ব আর বিনোদনের এই বদলে যাওয়া রূপ নিয়ে কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীর তাদের ভাবনা জানিয়েছে জাগো নিউজকে-
রিলসের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ‘রিয়েল’ সময়
তিথি দাস
শিক্ষার্থী, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল
‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই/কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই।’ একসময় বিকেল মানেই ছিল মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে হাসিখুশি সময় কাটানো, পরিবারের সঙ্গে গল্প করা কিংবা এক কাপ চায়ের সঙ্গে বইয়ের পাতা উল্টে দেখা। সেই মুহূর্তগুলো ছিল আন্তরিক ও সত্যিকারের, যেখানে কোনো অভিনয় ছিল না ছিল শুধু অনুভবের স্বচ্ছতা।
বইয়ের গল্পে খুঁজে পেত অনুপ্রেরণা আর ভাবনার জগৎ। কিন্তু এখন সেই বইয়ের জায়গা দখল করেছে রিলস। মানুষ বাস্তব সময় থেকে সরে গিয়ে যেন ডুবে যাচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। কয়েক সেকেন্ডের বিনোদনে মানুষ ডুবে যাচ্ছে সেখানে। পরিবার বা নিজের সঙ্গে কাটানোর সময়টুকু হারিয়ে যাচ্ছে স্ক্রিনে স্ক্রল করতে করতে।
রিলস বিনোদন দেয় ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ে কেড়ে নিচ্ছে আমাদের ‘রিয়েল’ সময়। চোখে আনন্দ দিলেও মনে রেখে যায় অব্যক্ত ক্লান্তি। জীবনের গতি যতই বাড়ছে, মনের শান্তি ততই কমছে। আগে সম্পর্ক গড়ে উঠত বই, চিঠি, গল্প আর উপস্থিতির আন্তরিকতায়। এখন সেই জায়গা দখল করেছে লাইক, কমেন্ট আর ইমোজি। আজ আমরা এমন সময়ে বাস করছি, যেখানে সবাই অন্যের জীবনের রিলস দেখে নিজের জীবন ভুলে যাচ্ছে। অন্যের সুখে হাসি, দুঃখে ইমোজি-ভরা সহানুভূতি কিন্তু বাস্তব জীবনের মানুষগুলোর জন্য সময় নেই।
রিলের ঝলকানি ক্ষণিক সুখ দেয়, কিন্তু প্রকৃত আনন্দ লুকিয়ে আছে বাস্তব মুহূর্তেই-মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া, বন্ধুর সঙ্গে খোলা মনে কথা বলা, কিংবা নিঃশব্দে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা সেই সোনালি বিকেলগুলোতেই।
অবসরের বদলে যাওয়া রূপ
রিকমা আক্তার
শিক্ষার্থী, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ
নব্বইয় দশকের বিকেল মানেই ছিল সব বয়সী মানুষের অবসর যাপনের সময়। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বিকেলে কেউ হাঁটতে বের হতো, বাচ্চারা বিকেল হতে না হতেই খেলায় মেতে উঠত, আর বই প্রেমীরা এক কাপ চা হাতে ডুবে যেত প্রিয় বইয়ের পাতায়। সেই সময়ের অবসর যাপনের সময়গুলো ছিল শান্ত, ধীর আর মানুষে মানুষে নৈকট্য গড়ে তোলার মুহূর্ত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে বদলে গেছে অনেক কিছু।
কালের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সময়ে এসে সে নব্বইয়ের সোনালি সময়গুলো আর নেই। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক ব্যক্তিদেরও দেখা যায় মোবাইল ফোন হাতে রিলস দেখায় মগ্ন থকতে। রিলস সংস্কৃতি আমাদের সাময়িক বিনোদন দিলেও কমিয়ে দিচ্ছে চিন্তা করার ক্ষমতা। যার ফলে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সৃজনশীল চিন্তাধারা। আমরা আগের মতো বসে গভীর মনোযোগ সহকারে কোনো বই পড়তে পারি না, অনুধাবন করতে পারি না কোনো লেখাও। সেই সময়টুকু ব্যয় করি রিলস দেখে। অথচ বই আমাদের ধৈর্য্য শক্তি বৃদ্ধি করে, চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ায়, প্রতিটি পাতায় খুঁজে পেতে সাহায্য করে নতুন প্রশ্ন, নতুন অভিজ্ঞতা।
সবশেষ আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু সমগ্র’ বইটি পড়েছি। এই বইটি শুধু চিন্তা করার ক্ষমতায় বৃদ্ধি করবে না বরং লেখকের কলমের সঙ্গে ঘুরে দেখা যাবে দেশ বিদেশের নানান জায়গা। আমাকে কেউ যদি বই আর রিলস থেকে একটা বাছাই করতে বলে, আমি নিঃসন্দেহে বই বেছে নিব। কারণ বই আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, শেখায়, সময়কে সুন্দর করে তোলে, অনুপ্রেরণা দেয় এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়।
রিলস: বিনোদন নাকি বিনিয়োগহীন সময়?
তানজিদ শুভ্র
শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর
প্রযুক্তি আমাদের সময় ও মনোযোগের মানচিত্র বদলে দিয়েছে। ব্যবহারকারীদের আগ্রহের কথা মাথায় রেখে ইউটিউব শর্টস, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের রিলসের মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করছে বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। ব্যস্ত নেটিজেনরা দীর্ঘ ভিডিওর বদলে কয়েক সেকেন্ডের রিলসে বেশি স্বস্তি খুঁজে নেয়। অল্প সময়ের বিনোদন দেখতে দেখতে কখন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, তা অনেকেই বুঝতে পারে না। নষ্ট হয় পড়াশোনা, কর্মঘণ্টা ও ইফেক্টিভ সময়।
যে বিকেলটি পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে কাটানোর কথা, আজ তা আটকে যায় স্ক্রিনের ভেতর। এমন দৃশ্য এখন পরিচিত পাঁচজন বন্ধু একসঙ্গে মাঠে বসে আছে, কিন্তু সবার হাতেই ফোন, মন পুরোপুরি স্ক্রলিংয়ে। এসব রিলস ভিডিও অনেক সময় আমাদের মধ্যে হতাশাও তৈরি করে। কারণ এক মিনিটের ভিডিওতে সাজানো জীবনের নিখুঁত রূপ দেখে নিজের বাস্তবতা ততটাই অগোছালো মনে হয়।
তবে একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গিও ঠিক নয়। রিলসের মাধ্যমে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, খবর বা শিক্ষামূলক টিপস শেয়ার করেন যা উপকারী। কিন্তু অবসর যাপনের মূল বিকল্প হিসেবে রিলসে আসক্তি কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। ছাপা বই পড়ার আনন্দ, বিকেলের খোলা হাওয়ায় হাঁটা, বাস্তব মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো এসব অভ্যাসই আমাদের মানসিক প্রশান্তি ও সত্যিকারের জীবনের কাছে ফিরিয়ে নিতে পারে।
প্রযুক্তির দখলে মাঠ, বই আর সম্পর্কের সময়
হুমাইরা খানম জেরীন
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
বর্তমানে অবসরের সময় কাটে কারো রিলস দেখে, কারো বা একের পর এক নিউজফিড স্ক্রল করে। আমরা বুঝতেই পারছি না কত দ্রুত প্রযুক্তির আড়ালে আসক্তির বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ছি। অথচ দু’এক দশক পেছনে তাকালেই চোখে ভেসে ওঠে চিঠির কাগজে কলমের গন্ধ, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে হাসিখুশি আড্ডা, দীর্ঘ ছুটিতে বাড়ি ফেরা আর মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ, শীতের সকালের গরম গরম পিঠার ধোঁয়া।
একসময় ডিসেম্বরের ছুটিতে সবাই প্রিয় গল্পের বইয়ে ডুবে থাকত; গ্রামের মাঠগুলো মুখর থাকত শিশু-কিশোরদের দৌড়ঝাঁপ, খেলা আর উল্লাসে। এখন সেই মাঠগুলো নিঃশব্দ মরুভূমির মতো ফাঁকা ও নির্জন। যে চিঠির অপেক্ষায় দিন গুনত প্রিয়জনরা, সে চিঠির ঘ্রাণ হারিয়ে গেছে প্রযুক্তির ডিজিটাল বার্তায়। বই পড়া ছিল গর্বের বিষয়, এখন বইকে পেছনে ফেলে দৌড়াচ্ছে সময় আর মানুষ।
তাহলে কি প্রযুক্তির নীরব গ্রাসে আমাদের মেধা ও অনুভূতির জগৎ হারিয়ে যাচ্ছে? হয়তো যাচ্ছে। তাই প্রয়োজন ফিরে আসার বই পড়ার অভ্যাস ফেরানো, চিঠির মতো আন্তরিক প্রকাশ ফিরিয়ে আনা। চাই সুস্থ বিনোদন, যেখানে পরিবার, বন্ধু আর প্রকৃতির মাঝে মানুষ আবার নিজেকে খুঁজে পায়। মাঠগুলো আবার মুখর হোক শিশুর হাসিতে, শব্দহীন স্ক্রল নয়, জীবনের স্পর্শ হোক আমাদের নতুন অবসর।
আরও পড়ুন
যে হাটে সংসারের গল্প বিক্রি হয় রঙিন পসরা সাজিয়ে
‘এমএ পাস চা ওয়ালা’র সাফল্যের গল্প বললেন সহিদুল
কেএসকে/এমএস