চাঁদ না থাকলে পৃথিবীর কী হবে?
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আজ রোববার ৭ সেপ্টেম্বর দেখা যাবে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে অনেক কল্পকাহিনি ও কুসংস্কার আছে। যার বেশিরভাগ প্রচলিত থাকলে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এখন সচেতন অনেকেই সেসব মানেন না। তবে চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে মাতামাতিরও শেষ নেই। অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বন্ধুবান্ধব বা পরিবার-প্রিয়জন নিয়ে চন্দ্রগ্রহণ দেখার।
বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী, চাঁদের পেনুম্ব্রাল গ্রহণ শুরু হবে ৭ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ২৮ মিনিট ২৫ সেকেন্ড থেকে। ৮ সেপ্টেম্বর ভোর পর্যন্ত চলবে। মোট ৭ ঘণ্টা ২৭ মিনিট স্থায়ী হবে চন্দ্রগ্রহণ। এবারের পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণকে ‘সুপার ব্লাড মুন’ নাম দেওয়া হয়েছে। আকারে সাধারণ সময়ের চাঁদের থেকে সাত শতাংশ এবং উজ্জ্বলতায় পনেরো শতাংশ বেশি হতে পারে এই সুপার ব্লাড মুন।
পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য যখন এই সরলরেখায় আসে, তখন পৃথিবীর ছায়ার জন্য চাঁদে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, ফলে চাঁদকে তখন কিছু সময়ের জন্য দেখা যায় না। অর্থাৎ পৃথিবী পৃষ্ঠের কোন দর্শকের কাছে চাঁদ আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন একে চন্দ্রগ্রহণ বলা হয়।
আচ্ছা কখনো ভেবে দেখেছেন কি, চাঁদ যদি না থাকে তাহলে পৃথিবীর উপর কি প্রভাব পড়বে? মানুষের উপর কি কোনো প্রভাব পড়বে? পৃথিবীর কোনো পরিবর্তন হবে কি? এই প্রশ্নটি যেমন বৈজ্ঞানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কল্পনার দিক থেকেও বিস্ময়কর। বাস্তবে যদি পৃথিবী তার একমাত্র উপগ্রহকে হারায়, তবে আমাদের গ্রহের জীববৈচিত্র্য, আবহাওয়া, সমুদ্র, এমনকি সময়ের গতিপ্রকৃতিও আমূল বদলে যাবে।
চাঁদ না থাকলে পৃথিবীর উপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে আসুন জেনে নেওয়া যাক-
১. দিনের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন
বর্তমানে পৃথিবী নিজের অক্ষে একবার ঘুরতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় নেয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে পৃথিবীর দিন অনেক ছোট ছিল মাত্র ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীর করেছে এবং সেটিকে ২৪ ঘণ্টার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। যদি চাঁদ না থাকে, তাহলে পৃথিবী ধীরে ধীরে আবার দ্রুত ঘুরতে শুরু করবে। কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যে হয়তো দিনের দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১২ ঘণ্টায় নেমে আসবে। এর মানে হলো, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের সময় অর্ধেকে নেমে আসবে, দিন-রাতের চক্র দ্রুত হবে। এর ফলে প্রাণিজগতের জৈবিক ঘড়ি বা সারকাডিয়ান রিদম পুরোপুরি বদলে যাবে।
২. জোয়ার-ভাটার উপর প্রভাব
চাঁদের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রভাব হলো জোয়ার-ভাটা। সমুদ্রের পানির এই ওঠা-নামা চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের কারণে ঘটে। যদি চাঁদ না থাকে, তবে জোয়ার-ভাটা সম্পূর্ণ বিলীন হবে না, কারণ সূর্যের টানও কিছুটা আছে। তবে সেই জোয়ার-ভাটা হবে অনেক দুর্বল। বর্তমান শক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এর ফলে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোটি কোটি বছর ধরে অনেক সামুদ্রিক প্রাণী জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে টিকে আছে। ডিম পাড়া, খাদ্য সংগ্রহ বা বংশবিস্তার সব কিছুই বদলে যাবে। ধীরে ধীরে এই প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

৩. পৃথিবীর অক্ষের স্থিতিশীলতা
চাঁদ পৃথিবীর অক্ষকে স্থিতিশীল রাখতে বড় ভূমিকা রাখে। বর্তমানে পৃথিবীর অক্ষ ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে হেলে আছে, যার কারণে আমরা ঋতুর পরিবর্তন পাই। চাঁদ না থাকলে এই অক্ষ অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে এবং একসময় ০ ডিগ্রি থেকে ৮৫ ডিগ্রির মধ্যে এদিক-সেদিক দুলতে শুরু করবে। ফলে কখনো পৃথিবী সম্পূর্ণ সোজা হয়ে যাবে তখন ঋতুর অস্তিত্ব থাকবে না; আবার কখনো এত বেশি হেলে পড়বে যে মেরু অঞ্চলগুলো সরাসরি সূর্যালোক পাবে। ফলস্বরূপ, কোনো সময় পৃথিবী প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠবে, আবার কোনো সময় ভয়াবহ বরফযুগে ঢুকে পড়বে। এই অস্থিতিশীল আবহাওয়া জীবজগতের জন্য বিরাট বিপদ ডেকে আনবে।
৪. জীবনের বিবর্তনে প্রভাব
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবীতে জীবনের বিকাশে চাঁদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। প্রাচীন কালে শক্তিশালী জোয়ার-ভাটার কারণে প্রাথমিক প্রাণীরা ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে স্থলে আসতে পেরেছিল। যদি চাঁদ না থাকত, হয়তো এই বিবর্তন ঘটতই না, অথবা অনেক দেরিতে ঘটত। আধুনিক জীববৈচিত্র্যও ভিন্ন হতো। আরও একটি দিক হলো চাঁদের আলো। রাতে চাঁদের আলো অনেক প্রাণীর চলাফেরা, শিকার বা প্রজননের সঙ্গে জড়িত। রাত সম্পূর্ণ অন্ধকার হলে খাদ্যশৃঙ্খল ও বাস্তুতন্ত্রে বড় পরিবর্তন আসত।
৫. মানুষের সভ্যতার বিকাশ
চাঁদ মানবসভ্যতার জন্য কেবল একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ নয়, বরং সংস্কৃতি, ক্যালেন্ডার ও বিজ্ঞানের অংশ। চন্দ্রপঞ্জিকা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, এমনকি কৃষির চক্রও অনেকাংশে চাঁদের সঙ্গে যুক্ত। যদি চাঁদ না থাকত, তাহলে হয়তো মানুষ রাতের আকাশ নিয়ে এত কৌতূহলী হতো না, জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিকাশ হতো অনেক ধীরে। এমনকি কবিতা, শিল্পকলা ও লোককথারও একটি বড় অংশ হারিয়ে যেত।
৬. জোয়ার-ভাটাজনিত শক্তি ও ভূতাত্ত্বিক প্রভাব
চাঁদের কারণে সাগরে সৃষ্ট জোয়ার-ভাটার শক্তি শুধু পানির ওঠানামা নয়, বরং পৃথিবীর ভূত্বককেও সামান্য প্রভাবিত করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় টাইডাল হিটিং। যদিও পৃথিবীতে এটি তুলনামূলক কম, তবুও দীর্ঘ সময়ে এটি পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। চাঁদ না থাকলে এই প্রভাব বন্ধ হয়ে যাবে, যার ফলে পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনে পরিবর্তন আসতে পারে।
৭. রাতের আকাশের পরিবর্তন
চাঁদ না থাকলে রাতের আকাশ নিঃসন্দেহে আরও অন্ধকার হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হয়তো এতে খুশি হতেন, কারণ তারা তারকা ও গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন আরও পরিষ্কারভাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে রাতের আকাশ হবে অনেক বেশি রহস্যময় ও ভীতিকর। গ্রামীণ জীবনে চাঁদের আলো যে ভূমিকা রাখে কৃষিকাজ, ভ্রমণ বা নিরাপত্তায় তা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে।
৮. পৃথিবীর জীবনের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, চাঁদ পৃথিবীর জন্য এক ধরনের ‘রক্ষাকবচ’ হিসেবে কাজ করে। বড়সড় গ্রহাণু বা ধূমকেতু অনেক সময় চাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়। যদি চাঁদ না থাকে, তবে এই সব মহাজাগতিক বস্তু সরাসরি পৃথিবীর দিকে আসতে পারে, যার ফলে জীবনের স্থায়িত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
সূত্র: রয়্যাল মিউজিয়াম গ্রিনউইচ, আর্থডেট, সাইন্সস্কুল
কেএসকে/জিকেএস