বিশ্ব আয়ুর্বেদ দিবস
রোগ প্রতিরোধ ও সার্বিক চিকিৎসায় আয়ুর্বেদ
ছবি: আয়ুর্বেদ চিকিৎসা
ডা. মো. মনির আহমেদ
আজ বিশ্ব আয়ুর্বেদ দিবস। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে দিবসটি। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আয়ুর্বেদ ফর পিপল অ্যান্ড প্ল্যানেট’, অর্থাৎ ‘মানুষ ও পৃথিবীর জন্য আয়ুর্বেদ’। আয়ুর্বেদ শুধু ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি সমাজ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষার সঙ্গে সুনিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।
আয়ুর্বেদের মৌলিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানবদেহের গঠনই হচ্ছে পঞ্চমহাভূত (আকাশ, মাটি, পানি, বায়ু ও অগ্নি) এর সমন্বয়ে, যা প্রকৃতিরই অংশ। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, মানবদেহ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ একে অপরের পরিপূরক। তাই প্রতিটি মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অতি-আধুনিকতা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন ও উন্নত জীবনযাপনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা আমাদের পরিবেশকে করছে দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর।
এছাড়াও উক্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা, অস্বাস্থ্যকর আহার-বিহার, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে না চলার কারণে আমরা প্রতিনিয়তই অসুস্থ হয়ে পড়ি। এমতাবস্থায় হাজার বছর ধরে চলে আসা প্রাকৃতিক চিকিৎসাপদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে রেজিষ্ট্রার্ড ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ না করে সিনথেটিক মেডিসিনের প্রতি অধিক নির্ভরশীলতার কারণে এবং নিবন্ধিত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই বিভিন্ন হারবাল ঔষধ সেবন করার কারণে রোগ থেকে পুরোপুরি মুক্তি না পেয়ে সাময়িকভাবে রোগকে দমন করে রাখছি যা পুরোপুরি সুস্থতা নয়।
এক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ, সুস্থতা বজায় রাখা এবং অসুস্থ হলে চিকিৎসা-এই মূলতত্ত্বের ভিত্তিতে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও সাস্থ্যসেবা গ্রহণ করার মাধ্যমে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার প্রকৃত ফলাফল পাওয়া সম্ভব। আসুন আয়ুর্বেদ কী কী ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করতে পারে তা জেনে নেই-
- রোগ প্রতিরোধে আয়ুর্বেদ
সুস্থ অবস্থায় রোগকে প্রতিরোধ করে সুস্থ ও নিরোগ জীবনযাপন করার জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রিভেনটিভ মেডিসিন হিসেবে রসায়ন ঔষধ সেবনের পরামর্শ প্রদান করা হয় এবং ডায়েটারি গাইডলাইন (পথ্য-অপথ্য) ও লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা হয়। এসব রসায়ন ওষুধ সেবন এবং স্বাস্থ্যকর দিকনির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চললে সুস্থ দেহ, প্রশান্ত মন ও আত্মিক সুস্থতার মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু লাভ করা সম্ভব হয়।
- সুস্থতা বজায় রাখতে আয়ুর্বেদ
শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে সুস্থ থাকা এবং সুস্থতাকে ধরে রাখার জন্য আয়ুর্বেদিক জীবনধারা যেমন; সদবৃত্ত পঞ্চক, ধর্মচর্চা, দিনচর্যা, রাত্রিচর্যা, ঋতুচর্যা, স্বাস্থ্যবৃত্ত ইত্যাদি যথাযথভাবে পালন করা। পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা, ইয়োগা, মেডিটেশন, আহার-বিহার, পর্যাপ্ত ঘুম ইত্যাদি নির্দেশনা মোতাবেক নিয়মিত পারণ করার (উপবাস) মাধ্যমে সুস্থতাকে দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয় এবং দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়।

- রোগ নিরাময়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা
যখন কোনো ব্যক্তি কোনো ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি ব্যতিত সব ধরনের রোগের শুরুতেই রেজিস্টার্ড আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক বিএএমএস (ব্যাচেলর অব আয়ুর্বেদিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি) এবং ডিএএমএস (ডিল্পোমা ইন আয়ুর্বেদিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি) চিকিৎসকদের নিকট আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুস্থতা লাভ করা সম্ভব হয়। চিকিৎসকগণ রোগীর রোগ পরীক্ষার মাধ্যমে কারণ, লক্ষণ, উপশয় ও সমপ্রাপ্তির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের একক ভেষজ যেমন; আমলকি, নিম, নিসিন্দা, হলুদ, বাসক, তুলসী, অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, কালোমেঘ, ব্রাক্ষী, থানকুনি, স্পিরুলিনা, জিঙ্কগো বিলোবা, জিনসেং ইত্যাদি এবং যৌগিক ওষুধ, চ্যাবণপ্রাশ, অশ্বগন্ধারিষ্ট, ব্রাক্ষী রসায়ন, ত্রিফলা, বাসকারিষ্ট, অরবিন্দাসব ইত্যাদি ঔষধ প্রয়োগ করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের অনুপান ও সহপান ও সাজেষ্ট করে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশে অধিকাংশ রোগীই শুরুতে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি তেমন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত বা তুলনামূলকভাবে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসম্পন্ন ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ঔষধ সেবনে আগ্রহ কম দেখায়।
- পরামর্শ
উক্ত সমস্যা সমাধানে এবং রোগী ও সাধারণ মানুষের মাঝে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা, ঔষধ, চিকিৎসাপদ্ধতি এবং একাডেমিক বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান, উৎসাহ প্রদান এবং এই চিকিৎসাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলার জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের এবং পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভিন্ন রোগ নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা, বিজ্ঞান-ভিত্তিক উপায়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত অগ্রগতী রিপোর্ট প্রকাশ, সাইন্টিফিক জার্নালে গবেষণা আর্টকেল প্রকাশ, স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন, হেলথ স্ক্রিনিং প্রোগ্রামসহ কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
এই বছরের বিশ্ব আয়ুর্বেদ দিবসে তাই অঙ্গীকার হোক রোগ প্রতিকার নয়, রোগ প্রতিরোধে প্রত্যেকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করবো। আসুন না কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলি যেমন-স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, স্বাস্থ্যকর আহার-বিহার গ্রহণ করা, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ যেমন-ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, ফ্রোজেন ফুড, রিফাইনড ফুড, প্রসেস ফুড, সুগার বেইজড, র্সট বেইজ, ফ্যাট অ্যান্ড ওয়েল বেইজড ফুড গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর রেখে পৃথিবীকে আমাদের বাসযোগ্য করে গড়ে তুলবো। আমাদের নতুন প্রজন্মকে একটি সুন্দর বাসযোগ্য স্বাস্থ্যকর পৃথিবী দেবো এই প্রত্যাশা রইলো।
লেখক: আয়ুর্বেদিক ওয়েলনেস প্রাকটিশনার, বিএএমএস (ডিইউ), এমপিএইচ (ইফিডেমিওলজি), এমফিল (বিইউপি), পিএইচডি গবেষক ইন স্বাস্থ্য-শিক্ষা, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), সহকারী অধ্যাপক, আয়ুর্বেদিক মেডিসিন বিভাগ, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
আরও পড়ুন
২১ নাকি ২২ ক্যারেট সোনা ভালো, আসল নকল চিনবেন যেভাবে
যেসব দেশে পরিচ্ছন্নতার জন্য আছে আইন, না মানলে জেল-জরিমানা
কেএসকে/জিকেএস